আজ ২৬ মার্চ,মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। নিত্যদিনের মতো আজও ভোরের সূর্যালোকের বর্ণচ্ছটায় রাঙাবে কৃষ্ণচূড়া, গ্রামীণ পথের শেষে নদীর তীরে অশ্বত্থ শাখা থেকে ভেসে আসবে কোকিলের কুহুতান, শ্যামল প্রান্তরের দূর-দূরান্ত থেকে বাজবে রাখালিয়ার মনকাড়া বাঁশি, নীল আকাশের বুকে ডানা মেলবে উড়ন্ত বলাকার ঝাঁক, কলকাকলিতে মুখরিত হবে জনপদ। তবুও অন্য যে কোন দিনের চেয়ে আজকের দিনটি সম্প�র্ণ আলাদা। ভিন্ন আমেজের, ভিন্ন স্বাদের আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা দিবস। জাতীয় জীবনের সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে গৌরবের স্মৃতি নিয়ে আবারও ফিরে এসেছে চির অম্লান মহান স্বাধীনতা দিবস। মৃত্যুপণ লড়াই ও রক্ত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বীর বাঙালি ছিনিয়ে এনেছে জাতীয় ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। স্বাধিকার আদায়ের দৃঢ় মনোবল নিয়ে পশুশক্তিকে পরাজিত করে ঘোর অন্ধকার অমানিশা কাটিয়ে বাংলার চিরসবুজ জমিনে রক্তে রাঙানো লাল-সবুজ পতাকার জন্ম হয় আজকের এই ঐতিহাসিক দিনেই। সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দু�শ বছরের ব্রিটিশ-বেনিয়া শাসনের অবসানের পর ২৪ বছর ধরে বিজাতীয় ভাষা ও গোষ্ঠীর শোষণ ও শাসনের শৃংখল ভেঙে আজকের দিনে মুক্তিকামী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনার মধ্য দিয়েই বাংলার মানুষের স্বপ্ন-সাধ ও কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সূচনা ঘটে। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস ও পটভূমি। একদিনের ঘোষণায় বা কারও বাঁশির শব্দ শুনে গোটা জাতি মরণপণ লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। ১৯৪৭ সালে অদ্ভুত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভক্তির পর থেকেই উর্দু শাসকদের নানা কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাঙালির রক্ত সংগ্রামের চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। মাতৃভাষার দাবিতে সেই ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে বায়ান্নর একুশে ফেব্র�য়ারির রক্তদান সংগ্রাম-আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জাতির রায়, ১৯৫৬-তে এসে সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি আদায়, ১৯৬২-এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ৬ দফার মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তি সনদ ঘোষণা, �৬৯-এর ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিদায় এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের ধারাবাহিকতায়ই এসেছে এই স্বপ্নের স্বাধীনতা। ১৯৭০-এর নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয়ের পর বাঙালির স্বপ্নপুরুষ, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়েই তিনি আইনগত ও সাংবিধানিকভাবে অর্জন করেন দেশ পরিচালনার ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা ঘোষণার যোগ্যতা। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, �এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এই জগদ্বিখ্যাত ঘোষণার মধ্য দিয়েই মূলত বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে যায়। খুঁজে পায় গেরিলা যুদ্ধের গোপন কৌশলও। তারপরও ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেফতারের আগে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর জাতিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সমগ্র জাতি দলমত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে �জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু� শ্লোগানকে বুকে ধারণ করে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিপাগল বাঙালির রক্তের বন্যায় ভেসে যায় বিশ্বখ্যাত পাকিস্তানের সুপ্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত দু�লক্ষাধিক হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, জ্বালাও-পোড়াও অভিযান �অপারেশন সার্চলাইট।� প্রায় এক কোটি মানুষের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ এবং মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দান, রাশিয়ার অস্ত্র সরবরাহ ও কূটনৈতিক সমর্থন এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধেই পৃথিবীর মানচিত্রে আরও একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। স্বাগতম হে স্বাধীনতা। তোমাকে জানাই হাজারও সালাম।
স্বাধীনতার স্মৃতিবিজড়িত দিনটিতে সমগ্র জাতি আজ বাঁধভাঙা প্রাণের উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হবে। একদিকে হাজার বছরের স্বপ্ন পূরণের সুখ ও আনন্দ, অপরদিকে স্বজন হারানোর ব্যথা-বেদনার এক আবেগঘন মিশ্র পরিবেশের মধ্য দিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবার, আ�ীয়-স্বজন ও মুক্তিকামী লাখো মানুষ নানা ব্যঞ্জনায় পালন করবে আজকের দিনটি। ফুলে ফুলে ভরে উঠবে জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ যাবতীয় স্মৃতির মিনার। হ�দয়পটে সৃষ্ট গভীর ক্ষত থেকে ভেসে উঠবে �রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম� এই পক্সিক্তমালার মর্মার্থ। স্বাধীনতার সাড়ে তিন দশক পর আজও আমাদের জাতির মুক্তি আসেনি। অর্জিত হয়নি স্বাধীনতার মূল দর্শন। শুধু একটি ভৌগোলিক সীমারেখা ও একটি পৃথক পতাকাই একটি দেশের মানুষের কাক্সিক্ষত মুক্তি এনে দিতে পারে না। আজও লাখো লাখো ভুখানাঙ্গা অনাহারি মানুষের দীর্ঘশ্বাস বাংলার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। বঞ্চনার শিকার হাজারও মানুষের দেখার কেউ নেই। মানবাধিকার বহু স্থানেই আজ উপেক্ষিত। দিন দিন গরিব আরও গরিব হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের অহঙ্কার। সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, রাজনৈতিক হানাহানি, সংঘর্ষ, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি আর প্রতিহিংসা দেশ ও সমাজকে খেয়েছে কুরে কুরে। পাশবিকতায় বন্দি হয়ে পড়ছে দারিদ্র্যক্লিষ্ট বহু জীবন। এদের কাছে সাধারণ মানুষ আজ বড়ই অসহায়। যেন দানবরা গুহা থেকে বেরিয়ে এসে খাবলে ধরেছে লাল-সবুজ মানচিত্র। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কালো থাবা বিস্তার করেছে।
তারপরও বলব, সর্বত্র এই নৈরাজ্য, অবক্ষয়, অস্থিতিশীলতা এবং অশান্তির মাঝেও কষ্ট করে নিঃশ্বাস ফেলছে মানুষ। এই অসহায়ত্ব নিশ্চয়ই দূর হবে একদিন। সেদিন বর্ণময় আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হবে বাংলার প্রকৃত রূপ। হেসে উঠবে চারদিক। সবাই গর্ব করে বলবে, এ দেশ আমার, এ মাটি সোনা, আমরা সবাই সূর্য সন্তান। সেই আশা জাগানিয়া স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে আজও মুক্তির প্রহর গুনছে বাংলার লাখো কোটি মানুষ।
Discussion about this post