দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপসম্পাকীয় বা লেখা নিয়ে অবশ্যই তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। আমার দেশ ‘ত্রুটিমুক্ত সাংবাদিকতা’ করে, এমন দাবি অবশ্যই করা যাবে না। পত্রিকাটির সঙ্গে জড়িত কেউ এমন দাবি করেন না। পৃথিবীর কোনো গণমাধ্যমই ‘শতভাগ ত্রুটিমুক্ত সাংবাদিকতার দাবি করতে পারে না, করেনি। আমার দেশ’র সাংবাদিকতাকে যারা ত্রুটি, তর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে চান, তারা নিরেট দলবাজির প্লাটফর্মে অবস্থান করছেন। যারা ‘চুদুরবুদুর’ জাতীয় শব্দে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে রাখার ‘শুধু প্রতিবাদ’ জানিয়ে ‘দায়ভার’ মুক্ত হচ্ছেন, তারাও ‘বক্তব্যবাজিতে সীমাবদ্ধ’ ধরণের রাজনীতি করছেন।
আমার দেশ’র বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে ‘অপসাংবাদিকতা’র অভিযোগ যারা করছেন, তারা আসলে স্বার্থের কারণে ‘শয্যাগত সাংবাদিকতা, সার্পোটিং জার্নালিজম, প্যাকেট জার্নালিজম, চেকবুক জার্নালিজম’র পক্ষে। প্রকাশিত লেখার জের ধরে আমার দেশ’র প্রকাশনা বন্ধ, এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে রাখা, তাঁকে একের পর এক রিমান্ডে নেয়ার বিষয়গুলোকে যারা সমর্থন করেন, তারা স্বৈরাচারী মানসিকতায় আক্রান্ত। তাদের সমর্থনের চাপে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে পত্রিকাটির সঙ্গে জড়িত হাজারো পরিবারের জীবিকার বিষয়টি। পত্রিকার ছাপা বন্ধ থাকায় চরম অনিশ্চয়তায় মুখোমুখি এসব পরিবারের সদস্যরা।
আমার দেশ ‘অপসাংবাদিকতা’ করে, সাংবাদিকতার প্রচলিত নীতিমালা মানে না- এমন দাবিতে কয়েকজন পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জোর দাবি জানাচ্ছেন। তারা হয়তো ভুলে গেছেন, আমার দেশ পরিবারের হাজারো সদস্যদেরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই। আর মাহমুদুর রহমান আমার দেশ পরিবারের কাছে অকৃত্রিম আন্তরিকতা, সততা নিয়ে দায়বদ্ধ। আমার দেশ’র বিরুদ্ধে ‘ধর্মীয় উস্কানি’র অভিযোগ প্রগতিশীল সমাজের। প্রগতিশীল সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমার দেশ ‘সাম্প্রদায়িক নীতি আদর্শে বিশ্বাসী’। তবে ‘সাম্প্রদায়িক নীতিমালা’র অপবাদ দিয়ে গণমাধ্যম বন্ধ করে রাখার দাবি কোনো দেশের প্রগতিশীল সমাজ আজ পর্যন্ত করেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, প্রগতিশীলতার পক্ষে দেশের বরেণ্য যেসব সম্পাদক আছেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই আমার দেশ’র প্রকাশনা খুলে দেয়া ও মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবিতে বিবৃতিতে দিয়েছেন। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর থেকে এ অঞ্চলে গণমাধ্যমের মধ্যে ‘প্রগতিশীল’ ও ‘সাম্প্রদায়িক’ বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠে। দিনে দিনে তা প্রকটতর হয়েছে। অবশ্য সাতচল্লিশের অনেক আগে থেকেই রাজনীতির হাত ধরে গণমাধ্যম জগতে প্রগতিশীলতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিভাজন রেখাটি স্পষ্ট ছিলো।
মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সঙ্গে এক পর্যায়ে এদেশে ‘সাম্প্রদায়িকতা’র সংজ্ঞাও পাল্টে গেছে। স্বার্থের পক্ষে বা বিপক্ষের হিসেবে প্রতিনিয়তই ‘সাম্প্রদায়িকতা’র সংজ্ঞা পাল্টাচ্ছে। দৈনিক প্রথম আলোর মতো প্রগতিশীল পত্রিকার বিরুদ্ধেও প্রখ্যাত কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী, মুনতাসীর মামুনসহ আরো কয়েক সাংবাদিক ‘সাম্প্রদায়িকতা’র অভিযোগ তুলেছেন বিভিন্ন সময়। বিশেষ করে আবদুল গাফফার চৌধুরী তাঁর বিভিন্ন লেখায় প্রমাণ করতে চেয়েছেন, ‘প্রথম আলো এতো সাম্প্রদায়িক নীতিমালায় বিশ্বাসী যে, এটি আসলে প্রগতিশীল ইনকিলাব!’ প্রথম আলোর প্রকাশনা শুরুর কাল থেকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘একুশ শতকের বটতলায়’ শিরোনামে উপসম্পাদকীয় লিখতেন। বছর কয়েক পরে প্রথম আলো তাঁর লেখা ছাপানো বন্ধ করে দেয়। এরপরই পত্রিকাটি তাঁর কাছে ‘সাম্প্রদায়িক’ হয়ে উঠে। দৈনিক ইত্তেফাকের মতো ঐতিহ্যবাহী, প্রাচীন পত্রিকার বিরুদ্ধেও আবদুল গাফফার চৌধুরী তাঁর এক বইয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা’র অভিযোগ তোলেন।
আমার দেশ’র তুলনায় প্রথম আলো, ইত্তেফাক আলাদা ধারা, নীতিমালার পত্রিকা। এগুলোকে উদাহরণ হিসেবে নিলে ‘সাম্প্রদায়িকতা’র সংজ্ঞা অস্পষ্টতায় ঢাকা পড়ে যায়। আমার দেশ’র বিরুদ্ধে ‘সাম্প্রদায়িক উস্কানি’র অভিযোগ একেবারেই নতুন। স্পষ্ট করে বললে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে। ‘সাম্প্রদায়িক উস্কানি’র অভিযোগের আগেও ২০১০ সালের ১ জুনে আমার দেশ’র প্রকাশনা বন্ধ, এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে। এতে দু’পর্যায়ে দীর্ঘ ৪৭ দিন পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ থাকে। রাজপথে সাংবাদিক, সংবাদকর্মীদের সাহসী আন্দোলন, আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ‘মৃত্যুদণ্ড’ পাওয়া পত্রিকাটির দ্বিতীয় পুন:প্রকাশ হয় ওই বছরের ১৯ জুলাই। আমার দেশ ‘সাম্প্রদায়িক উস্কানি’র অভিযোগে বন্ধ আছে, এ দাবির তাই প্রমাণ মেলে না। মূলত রাজনৈতিক কারণে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ, সম্পাদককে গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে। এ রাজনীতির ভেতরেও হয়তো ‘রাজনীতি’ লুকিয়ে আছে। তবে সেখানে প্রগতিশীলতা নেই। তাই ‘প্রগতিশীল রাজনীতি’র দোহাই দিয়ে পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে রাখার বিষয়টিকে বৈধতা দেয়া যায় না।
আমার দেশ ‘অপসাংবাদিকতা’ করে, ঢালাওভাবে এমন মন্তব্য করাটা নি:সন্দেহে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ঢালাওভাবে ‘অপসাংবাদিকতা’র অপবাদটা মূলত বিকাশ লাভ করেছে সামরিক শাসক, স্বৈরাচারীদের কাছ থেকে। এশিয়ান সাংবাদিক জোয়ান মাক্সতো ও অ্যালান চকলি ১৯৬৩ সালে সাংবাদিকতার ভুবনে ‘উন্নয়ন সাংবাদিকতা’র ধারণা উপস্থাপন করেন। সত্তরের দশকে ফিলিপাইনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ‘উন্নয়ন সাংবাদিকতা’ প্রত্যয়টি নিয়ে আলোচিত হয়। পরে সারা পৃথিবীতে পরিচিতি পায় ‘উন্নয়ন সাংবাদিকতা’। এক পর্যায়ে ‘উন্নয়ন সাংবাদিকতা’র নাম করে গণতান্ত্রিক সরকার নিজেদের প্রপাগান্ডা প্রচার করতে থাকে। এমনকি সামরিক শাসকরাও ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে ব্যবহার করে ‘উন্নয়ন সাংবাদিকতা’কে। স্বাধীনতাত্তোর আফ্রিকান ক্ষমতাসীনরা ‘উন্নয়ন সাংবাদিকতা’কে ক্ষমতা চিরস্থায়ী ও সংহতিকরণে ব্যবহার করতে থাকেন। এশিয়ার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ইত্যাদি দেশেও তখন সামরিক শাসকরা গণমাধ্যমকে ওইভাবে ব্যবহার করেন। ষাট ও সত্তরের দশকের দশকে স্বাধীন হওয়া অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা ‘উন্নয়ন সাংবাদিকতা’কে ব্যবহার করেন রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। এসব কারণে পশ্চিমা সাংবাদিকরা ‘উন্নয়ন সাংবাদিকতা’কে ‘এন্টি ওয়েস্টার্ন জার্নালিজম’ নামে অভিহিত করেন।
অভিযুক্ত দেশে শাসকশ্রেণীর কবল থেকে ‘উন্নয়ন সাংবাদিকতা’ মুক্ত হতে চাইলেই শাসকগোষ্ঠী সেটাকে ‘অপসাংবাদিকতা’ হিসেবে অ্যাখায়িত করতে থাকে। আমার দেশ প্রচলিত নীতিমালা মানেনি, এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ‘সাংবাদিকের জাত’ নন, তিনি ‘হঠাৎ সম্পাদক’; এটা প্রমাণ, প্রচারের বিশেষ গুরুদায়িত্ব অবিরাম পালন করে যাচ্ছেন কয়েকজন। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আলোচনা-সমালোচনা চলতে পারে। সেটা ‘বিদ্বেষপ্রসূত, উদ্দেশ্যমুলক, অন্যায় ঢেকে রাখার অভিপ্রায় থেকে’ না হওয়াটাই কাম্য। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভিন্ন মতের চর্চা চলতে পারে, এ যুক্তিতে তাদের বক্তব্য সমর্থন করলে বলতে হবে, ভিন্ন মতের আমার দেশ’র প্রকাশনা বন্ধ বা এর সম্পাদককে আটক করে রাখা কোনো অর্থেই গণতান্ত্রিক আচরণ নয়। রাজনৈতিক মতাদর্শ, কর্মকাণ্ডের দিক থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহা
Discussion about this post