মেয়ে সন্তান হয়েছে বলে অভিমানে স্ত্রীর মুখ দেখেননি, এমন গল্প আগে ঘরে ঘরেই শোনা যেত। ছেলে সন্তানের জন্ম যেখানে উৎসব, সেখানে মেয়ে শিশুর জন্ম মানেই ছিল শোকের পরিবেশ। তবে কন্যা শিশুর জন্য এখন সেই সময় অনেকটাই বদলে গেছে।
আগের তুলনায় বর্তমানে কন্যা শিশুর জন্য বাবা-মায়ের চাহিদা বেশ বেড়েছে। এখন আর মেয়ে সন্তান হলে খুব বেশি একটা নেতিবাচক চোখে দেখা যায় না।
তবে এই পরিবর্তনটা খুব কম সময়ে আসেনি। এক্ষেত্রে ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান, অর্থনীতি ও গ্রামীণ পরিবেশ খুব দরকারি ফ্যাক্টর। যারা দরিদ্র তাদের ভাবনা থাকে, মেয়েটাতো শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, তাহলে মেয়েটা বাবা-মাকে কিভাবে দেখবে। ছেলে হলে আর সেই সমস্যা থাকে না।
এই জায়গায় মেয়ে নিয়ে ভাবনায় একেবারে পরিববর্তন আসেনি। তবে এখন মেয়েরা ঘর থেকে বের হয়েছে। আবার অনেক মেয়ে ঘরমুখীও হচ্ছে। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে বা সন্তান হওয়ার পরে চাকরি ছেড়ে দেয়। অনেক মেয়ে আছে যারা স্বামীরা অ্যাফোর্ড করতে পারলে চাকরি ছেড়ে দেয়।
পরিবর্তন আনতে হলে বেশ কিছু জায়গায় নজর দিতে হবে। বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের সমান অংশগ্রহণ নেই। ফলে এই সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। তাই সমস্যা সমাধানে পরিবার খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ছেলে যেমন মেয়ের সঙ্গে ঘরে কাজ করবে, মেয়েও ছেলেদের মতোই সব ধরনের সুবিধা পাবে। সব সন্তানকেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে দেখা যাবে সেই পরিবারের মেয়েরা অনেক ভিন্নভাবে বেড়ে উঠবে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু এবং এদের মধ্যে ৪৮ শতাংশই কন্যাশিশু। শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হলেও আজও দেশের অধিকাংশ কন্যাশিশুর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছরের আগেই।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে-২০০৭ এর তথ্য অনুযায়ী দেশে এখনও ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে এবং দুই দশক ধরে এ হারের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। আর ১৯ বছরের আগেই গর্ভবতী হচ্ছে ৬৬ শতাংশের এক শতাংশ। বাংলাদেশে নারীর গড় বিয়ের বয়স ১৫ বছর ৩ মাস।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, শিশু বিবাহের হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। গত ৩০ বছরে শিশুবিবাহ আনুপাতিক হারে হ্রাস পেলেও গ্রামাঞ্চলে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমস্যাটা প্রকট।
সারা দেশে নারীদের প্রতি যেসব সহিংসতা চলছে সেই কারণেও অনেকে মেয়ে সন্তান চান না। মেয়েদের আমরা অনেক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে বড় করছি, এর সঙ্গে বাল্য বিয়ে তো আছেই।
একটি পরিবারে মেয়েরা যে পরিমাণ না শুনে বড় হয়, একটি ছেলে সেই পরিমাণ না শব্দ শুনে বড় হয়নি। ছেলেকে আমরা যে পরিমাণ সমর্থন দেই, মেয়েদের সেই পরিমাণ সমর্থন দিতে পারি না। এসব বিষয়সহ আরও অনেক ক্ষেত্রে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হলে এতটা সহিংসতা হতো না।
কন্যা শিশুর প্রতি জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য রোধে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু বিকাশের বিষয়টিকে বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার লক্ষ্যে ২০০০ সালে তৎকালীন সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি সরকারি আদেশের মাধ্যমে শিশু অধিকার সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনকে কন্যাশিশু দিবস হিসেবে পালনের লক্ষ্যে ৩০ সেপ্টেম্বরকে ‘জাতীয় কন্যা শিশু দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। তখন থেকেই প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হচ্ছে।
শিশু অধিকার সপ্তাহ ও কন্যাশিশু দিবসের উদ্দেশ্য হলো, শিশুদের ব্যাপারে যেন আমরা যত্নবান হই, তারা যেন কোনো বঞ্চনা বা অবহেলার শিকার না হয়, সে জন্য সবাইকে সচেতন করা। কিন্তু যে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যে দিবসটি পালিত হয়, সেই উদ্দেশ্য কি আদৌ পূরণ হচ্ছে? আসলেই কেমন আছে আমাদের কন্যাশিশুরা?
আমাদের দেশের মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। দেশের ৬৬ শতাংশ মেয়েরই বিয়ে হচ্ছে অল্প বয়সে। আমাদের দেশে যত শিশু অপুষ্টিতে ভোগে, তার বেশির ভাগই মেয়ে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, এক থেকে চার বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে ছেলেশিশুদের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি মেয়েশিশু পুষ্টিহীনতায় ভোগে। পাঁচ বছরের কম বয়সী মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে ১১ শতাংশ কম ক্যালরিযুক্ত খাদ্য পায়।
এই হচ্ছে আমাদের দেশের কন্যাশিশুদের অবস্থা। ভাবা যায়? হয়তো যায়। কেমন যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে কন্যাশিশুদের ওপর এসব নিগ্রহের বিষয়। আমাদের দেশে মনে হয় সবই সম্ভব। কেমন করে বাঁচবে এখানে শিশুরা?
সময় হয়েছে কন্যাশিশুদের ওপর এসব বর্বর আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। সে জন্য শুধু রাষ্ট্র বা সরকার নয়, সচেতন হতে হবে গোটা সমাজকে। শুধু দিবস পালনের মধ্যে কার্যক্রম সীমিত রাখলে চলবে না, কন্যাশিশুদের কল্যাণে বাস্তবসম্মত কাজ করতে হবে। দিবসের মর্মটিকে সবার মনের গভীরে কীভাবে পৌঁছে দিতে পারি, তা নিয়ে ভাবা ও কাজ করার সময় এসেছে।
লেখক : ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, কলামিষ্ট, সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ ।
Discussion about this post