মঈন উদ্দিন সরকার সুমন, কুয়েত থেকে| মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম তেল সমৃদ্ধ ধনী দেশ কুয়েত। দেশটির দক্ষিণে সৌদি আরব ও উত্তরে ইরাক বেষ্টিত শেখ শাসিত রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। রাজধানীর নাম মাদিনাত আল-কুয়েত বা কুয়েত সিটি।প্রায় আঠার হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে বিশ্বের সব দেশের প্রবাসী রয়েছে। দেশটির জনসংখ্যার অনুপাতে প্রয়োজনীয় সকল পণ্য অন্য দেশ থেকে আমদানি করে থাকে। মিসর, সিরিয়া, ভারতীয়, ফিলিপিনো, পাকিস্তানি সহ বাংলাদেশের প্রবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। বর্তমানে প্রায় তিন লাখের উপরে প্রবাসী বাংলাদেশী কুয়েতে আছেন। স্বাদের দিকে বাংলাদেশ, ভারত প্রায় সমান হওয়ায় ভারতীয় পণ্য যেমন অন্যদেশিদের পাশাপাশি বাংলাদেশীরা পছন্দ করেন তেমনি বাংলাদেশী পণ্য গুলো ভারতীয়দের কাছেও বেশ পছন্দের। কুয়েতের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী ব্যবসায়ী চেষ্টা করে যাচ্ছেন বাংলাদেশী পণ্য কুয়েতের বাজারে সম্প্রসারণের মাধ্যমে নিজ ব্যবসা ও দেশের পণ্যের বাজারজাত করনে। বাংলাদেশের সুনামধন্য পণ্য প্রাণ, রাধুনী, এলিন ফুড, এসিআই, সজিব, বোম্বে সুইটস, অলিম্পিক বিস্কুট, টাইগার ড্রিংক্স সহ অসংখ্য পণ্য এখন কুয়েতের বাজারে বিভিন্ন দোকানে ও সুপার মার্কেটে দেখা যায়। এই সকল পণ্য কুয়েতের মত একটি উম্মুক্ত বাজারে সুনামের সহিত টিকে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিছু বাংলাদেশী। তথ্য নিয়ে জানতে পারি এই ব্যবসায়ীরা অনেকে কোন না কোন কোম্পানি বা কুয়েতীর মালিকানায় ভিসা নিয়ে কর্মী হিসেবে কুয়েত আসেন। নিজ মেধা, সততা আর কঠোর পরিশ্রমে তারা আজ প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্রান্ডের পণ্য কুয়েতের বাজারে এনে এখন নিজেরাই এক একজন ব্রান্ড হিসেবে পরিচিতি লাভ করে চলেছেন। তারা অন্য লাখো প্রবাসীর মতো নয়, তাদের অগ্রগতি অন্য সাধারণ প্রবাসীদের জন্য এগিয়ে যাওয়ার পথ পদর্শক হিসেবে কাজ করবে।
আজ এমন একজন সফল তরুণ প্রবাসী ব্যবসায়ীর কথা বলব যে বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত তাঁর পণ্যগুলি কুয়েতের বাজারে অনেকটা পরিচিতি থাকলেও অনেকই চেনেন না তাকে।এলিন ফুড, বোম্বে সুইটস, হাসেম ফুডের সজিব ব্রান্ড এর পন্য, অলিম্পিক বিস্কুট, টাইগার এনার্জি ড্রিংক কুয়েতের বাজারে সয়লাব করেছে এরই মধ্যে।
নাম মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম(৩৮)হলেও বন্ধু মহলে মুফতি ( বাংলাদেশে কাওমি মাদ্রসা থেকে ইসলামী আইনের উপরে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করলে তাকে মুফতি উপাধি দেয়া হয়) উপাদিতে সম্মান করেই ডাকে সবাই। পিতা মুহাম্মদ সুলতান আলী পেশায় একজন কৃষক, দেশের বাড়ী বরিশালের পিরোজপুর জেলার কাউখালী থানার বেকুটিয়া গ্রামে। মাদ্রসা দারুল উলোম মিরপুর থেকে দাওরাই হাদিস (মাষ্টার্স সমমান) শেষ করে ইসলামী আইনের উপর সর্বোচ্চ ডিগ্রী (মুফতি) শিক্ষা অর্জন করেন। এরপর কিছুদিন দেশে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। ২০০৫ সালে কুয়েতে আসেন। এক কুয়েতি মালিকের অধিনে দুই বছর চালক হিসেবে কাজ করেন।ইচ্ছা থাকলে ঠেকায় কে। ঐ দুই বছর চালক হিসেবে কাজ করার সুবাধে বিভিন্ন স্থানের পরিচিতি ও মার্কেটের অবস্থান সম্পর্কে ভালই অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ওখান থেকে বের হয়ে একটি কোম্পনিতে সেল্সম্যান এর চাকুরী নেন। মার্কেটিং সম্পর্কে ভালো অভিজ্ঞতা থাকায় নিয়োগ পান প্রাণ কোম্পানির কুয়েত ম্যানেজার হিসেবে। দীর্ঘ সাত বছর একটানা প্রাণ কোম্পানীর অধিনে কাজ করে বাংলাদেশী পণ্য কুয়েতের বাজারে সম্প্রসারণে বেশ এগিয়ে যান । পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেন কুয়েত এর বাজার ও চাহিদা সম্পর্কে। পূর্ব থেকেই ব্যবসা করার চিন্তা ছিলো মাথায়। অভিজ্ঞতা আর পুজি না থাকায় শুরুতে বেশ বেগ পুহাতে হয়েছে। প্রায় ৯/১০ বছর চাকুরী করে এক দিকে জমিয়েছেন পুজি অন্য দিকে অর্জন করেছেন অভিজ্ঞতা এই নিয়ে শূরু করেন ব্যবসা।
প্রথমেই এলিন ফুড কুয়েতে আনেন বাজার জাত শুরু করেন। আস্তে আস্তে ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। একে এক বাংলাদেশ থেকে আনতে থাকেন হাসেম ফুডের সজিব ব্রান্ড এর পন্য, অলিম্পিক এর বিস্কুট, টাইগার এনার্জি ড্রিংক, বোম্বে সুইটস, ভিয়েতনাম থেকে কোকনাট ওয়াটার বাসেল সীড সহ বিভিন্ন জুস ড্রিংক, সহ দুবাই থেকেও বিভিন্ন পণ্য এনে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। শুধু এতেই সিমাবদ্ধ নেই এখন ২০১৫ সাল থেকে তার কোম্পানি আল মাহাসেল এর নিজস্ব মাহাসেল ব্রান্ডে বিভিন্ন স্পাইসি মসল্লা যেমন হলুদ, ধনিয়া, তেজপাতা,মুড়ি, শরিষার তৈল ও কারী পাওডার সহ বেশ কিছু আইটেম এথন কুয়েত ও ইরাকে বেশ চলছে বলে এনটিভি অনলাইনকে জানান এই তরুন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম। প্রতিবেদক মঈন উদ্দিন সরকার সুমন তার ফরওয়ানিয়াস্থ বিশাল গোডাউন সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এক বিশাল বিল্ডিং এর নিচে ৯৫০০ স্কয়ার ফিট পুরোটা জুড়েই তার ষ্টোর, যেখানে বিভিন্ন পণ্যে পরিপূর্ণ। একদিকে ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি অন্যদিকে বাংলাদেশী পণ্য বিদেশের বাজারে সম্প্রসারনে আপ্রাণ চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক প্রতিকুলতার মধ্যদিয়েই বলা যায়। অনেক সমস্যার কথাও বলেছেন তিনি। বাংলাদেশ কে বিশ্বের বাজারে তাল মিলিয়ে চলতে আরো সহনশীল ও উদ্যোগী হতে হবে বলে মনে করেন।
তিনি বলেন বাংলাদেশ থেকে একটি পণ্য কুয়েতে আসতে প্রায় তিন মাস সময় লেগে যায় যা প্বার্শবর্তী দেশ থেকে এক থেকে দের মাসেই চলে আসে পণ্য।এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন তাদের পন্যগুলি বিদেশ আসে চট্টগ্রাম এর পোর্ট দিয়ে। দেশের ভিতর বিভিন্ন আন্দোলনের কারণে এক দিকে দেড়ি হয় এর চেয়ে বড় সমস্যা এই কন্টিনার গুলো যে সব জাহাজে করে নেয়া হয় ঐ সকল জাহাজ বেশ বড় হওয়ায় সরাসরি পোর্টে যেতে পারে না। এই বড় জাহাজে কন্টিনার লোড করা হয় ছোট জাহাজের মাধ্যমে এর কারণে বাড়তি খরচও গুনতে হয়।বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা, দুবাই হয়ে কুয়েতে প্রবেশ করে। তিনি জানান কুয়েতে ব্যবসা উম্মুক্ত যে যেই ব্যবসা করতে চান সরকারের নিয়ম অনুযায়ি করতে পারেন। এখানে কোন সিন্ডিকেট চক্র না থাকায় সবসময় বাজারে প্রতিযোগিতা লেগে থাকে। প্রতিনিয়ত কোন না কোন মার্কেটে প্রমোশন চলতেই থাকে। বাংলাদেশী পণ্যের মান নিয়ে বলতে গেলে তিনি জানান বাংলাদেশী পণ্যের মান অনেক ভালো তবে উন্নত প্যাকিং এর কারণে পূর্বে বাজার ধরতে অনেক হিমশিম খেতে হয়েছে । তারাও (বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা) এখন বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্ভন করছেন।তাঁর এখানে বাংলাদেশী সহ ইন্ডিয়া ও মিসরের লোকজন কাজ করেন। তিনি বংলাদেশী কর্মীদের প্রতি বেশি প্রশংসিত, কারণ হিসেবে বলেন বাংলাদেশের পণ্য একমাত্র বাংলাদেশীরাই মর্যাদা বেশি দেবেন।
তিনি চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ থেকে কিছু অভিজ্ঞ সেল্সম্যান আনার। ভিসা (বিশেষ অনুমতি নিয়ে) জটিলতা এখানে বাধাঁ হিসেবে দাড়িয়েছে।
অজপাড়া গাঁয়ের একজন কৃষকের সন্তান হয়ে মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে এমন বড় স্বপ্ন দেখা সহজ ছিলো। কিন্তু বাস্তবে রুপান্তর করা কতই কঠিন তার জলন্ত প্রমাণ শহিদুল ইসলাম নিজেই। বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত তাঁর পণ্যগুলি কুয়েতের বাজারে অনেকটা পরিচিত থাকলেও মুফতি মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম কে অনেকই চেনে না। নীরবে নিভৃতে ব্যবসা করে যাচ্ছেন তিঁনি, নিজের অতিতের কথা মনে করেন, গরিব দুঃখি মানুষে সেবা করার আশা ব্যক্ত করেন। সততা, নিষ্ঠা আর কঠোর পরিশ্রম করলে আল্লাহ অবশ্যই ভাগ্য পরিবর্তন করবেন বলে বিশ্বাস করেন তিনি।
Discussion about this post