সিএসডিএফ’র জেন্ডার বাজেটিং শীর্ষক নাগরিক সংলাপে বক্তারা, নারীদের গৃহকর্মের আর্থিক মুল্য নির্ধারণ ও স্থানীয় সরকার কেন্দ্রিয় সরকারের করুণা নিয়ে চললে নারীরা ন্যায্য হিস্যা পাবে না-প্রেস বিজ্ঞপ্তি
কামরুন্নাহার শাম্পা- সরকারের বাজেট প্রণয়নের সময় নারী গৃহকর্মের আর্থিক মুল্য নির্ধারন করা হয় না। ফলে নারী ঘরে বাইরে যে পরিমান শ্রম দিয়ে থাকে তা জাতীয় অর্থনীতি চাকায় তার আর্থিক মুল্য বিবেচনায় স্থান পায় না। গৃহাভ্যন্তরে নারী পরিবারের সদস্যদের দেখাশুনা, সন্তানদের লোপড়া, অসুস্থ ও বয়স্বকদের সেবা, খাবার পারি, জ্বালানী সংগ্রহ, গবাদী পশু পালন প্রভৃতির মাধ্যমে নারীরা যে বিরাট ভুমিকা রেখে চলেছেন তার আর্থিক মুল্য নির্ধারন না হওয়ায় বাজেটে তাদের জন্য আলাদা ও যুক্তিসংগতভাবে ব্যয় বরাদ্দ নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায়। একই সাথে জাতীয় বাজেটে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের জন্য গনতান্ত্রিক ও সমভাবাপন্ন রূপ দিতে হলে প্রথমে বাজেটের ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করা এবং সেখানে নারী-পুরুষ, উচ্চবিত্ত নারী-দরিদ্র নারী, মধ্যবিত্ত নারী-নি¤œবিত্ত নারী, মুসলিম নারী-হিন্দু নারী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের নারী, কর্মজীবি নারী-গৃহবধু ইত্যাদি প্রান্তিক মানুষগুলির কথা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। তাহলেই একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায্য বাজেট প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। আর স্থানীয় সরকার যদি স্থানীয় জনগনের দ্বারা, জনগনের কল্যানে এবং অংশিদারিত্বে পরিবর্তে কেন্দ্রিয় সরকারের করুনায় পরিচালিত হয় তাহলে সেটি স্থানীয় জনগনের চাহিদা মিটাতে সক্ষম হবে না। এটি কোন ভাইে কেন্দ্রিয় সরকারের এজেন্ট হিাসাবে কাজ করতে পারে না। সেজন্য প্রয়োজন সত্যিকার অর্থে স্থানীয় সরকারে স্থানীয় জনগনের ক্ষমতায়ন ও জনগনের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ২ এপ্রিল নগরীর জেলা পরিষদ মিলানয়তনে চিটাগাং সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট ফোরামের (সিএসডিএফ), জেলা সামাজিক উদ্যোক্তা পরিষদ ও সুফিয়া কামাল ফেলোদের উদ্যোগে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক নীতিমালার আলোকে স্থানীয় সরকারের বাজেট ও পরিকল্পনায় নারীর মানবাধিকার ইস্যু যুক্ত করার দাবীতে আয়োজিত নাগরিক সংলাপ এ বিভিন্ন বক্তাগন উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
সিএসডিএফ’র চেয়াপার্সান এস এম নাজের হোসাইনের সভাপতিত্বে এবং সিএসডিএফ’র ভাইস চেয়ারম্যান কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত নাগরিক সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রশাসক এম এ ছালাম। প্যানেল আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক হোসাইন কবির, সাবেক সংসদ সদস্য ও চাকসুর ভিপি মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী, চট্টগ্রাম সিটিকর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী, জাসদ(মাহফুজ) নেতা ডাঃ মাহফুজুর রহমান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগরে চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডঃ জিনবধু ভিক্ষু। সংলাপে মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিএসডিএফ’র সাধারন সম্পাদক ও বিশিষ্ঠ নারী নেত্রী জেসমিন সুলতানা পারু। আলোচনায় অংশনেন চট্টগ্রাম সিটিকপোরেশনের কাউন্সিলর আফরোজা কালাম, আঞ্জুমান আরা বেগম, ফেরদৌসী তাহের, জাহানারা মোস্তাফিজ, চন্দনাইশ উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান খালেদা আকতার চৌধুরী, বাশখালী উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ইয়ামুন্নাহার, পটিয়া উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাজেদা বেগম সিরু, বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ ফোরাম চট্টগ্রামের সভাপতি সরোয়ার উদ্দীন চৌধুরী, মোমেনা আকতার নয়ন, জেলা সামাজিক উদ্যোক্তা পরিষদের সাধারন সম্পাদক অজয় মিত্র শংকু, বরমা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মনসুর হাবিব, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন চট্টগ্রামের সভানেত্রী সেতারা গফ্ফার চৌধুরী, উত্তর জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সভাপতি সাবিহা মুসা, নারী নেত্রী ও সুফিয়া কামাল ফেলো জন্নাতুল ফেরদৈাস, আবিদা আজাদ, সায়মা হক, জেসমিনা খানম, রুবি খানম, ফাতেমা ইদ্রিস, জেসমিনা পারভীন জেসী, মমতার প্রকল্প পরিচালক তালুকদার, ইপসার শহিদুল ইসলাম, পার্কের নজরুল ইসলাম, ডিএসকে’র জন্নাতুল ফেরদৌস, সামাজিক উদ্যোক্তা পরিষদের নেতা জানে আলম, জাহাঙ্গীর মোস্তাফা, হারুন গফুর ভুইয়া, রাশেদ খান মেনন, তৌহিদুল ইসলাম, হাজী আবু তাহের, হাজী ইকবাল আলী আকবর প্রমুখ। সংলাপে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর, উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য, রাজনীতিবিদ, সরকারী কর্মকর্তাসহ ও বিভিন্ন নারী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সভায় বিভিন্ন বক্তাগন বলেন জাতীয় সংসদ সদস্যগন আইন সভার সদস্য হিসাবে দেশের জন্য আইন প্রনয়ণের কথা থাকলেও বর্তমানে আইন প্রনয়নের চেয়ে উন্নয়ন কর্মকান্ড মনিটরিং, বরাদ্দ ইত্যাদি নিয়ে বেশী ব্যস্ত। আর একশ্রেনীর আমলাদের খামখেয়ালীপনার কারনে আজকে ঢাকা মানেই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ মানেই ঢাকা। সবকিছুই ঢাকা কেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে কোন প্রক্রিয়া বা কোন স্দ্ধিান্ত গ্রহনকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। সেকারনে স্থানীয় সরকারগুলি জনগনের চাহিদা মাফিক কোন কাজ করতে পারছে না। স্থানীয় সরকারগুলি সত্যিকার অর্থে ক্ষমতায়িত হচ্ছে না। বক্তাগন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন আমিনীদের প্রেতাত্মা প্রগতিশীল মানুষের উপর ভর করে থাকায় অনেক প্রগতিশীল লোকজনও জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি মালা, ২০১১ ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১১ নিয়ে কথা বলতে চান না। ফলে আমিনীরা নারী নীতি ও শিক্ষানীতি নিয়ে হরতাল করলেও প্রগতিশীল মহলের অনেক লোকজন তখন নিরব ছিল। যা সত্যিই দুঃখজনক।
সংলাপে উপস্থাপিত মুল প্রবন্ধে বলা হয় সাধারণত সরকারের অর্থ মন্ত্রনালয়ই বাজেট তৈরী করে থাকে। স্থানীয় পর্যায়ে বাজেট তৈরী করার জন্য সরকারের মন্ত্রণালয় থেকে একটি ফরমেট প্রেরণ করে থাকে। যেটি তারা পুরণ করে সংস্লিষ্ঠ দপ্তরে প্রেরণ করে থাকেন। বাজেট প্রণয়নের সাথে এই পুরো প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত সিংহভাগই পুরুষ আর নারী ইস্যু এবং জেন্ডার সম্পর্কে ধারনা না থাকার কারনে নারী-পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ও চাহিদার কথা বিবেচনায় আনা সম্ভব হয় না। প্রতিটি সেক্টর ধরে তাদের চাহিদা অনুযায়ী ব্যয় বরাদ্দের কোন বিধি নেই। সেকারনে জাতীয় বাজেটকে জেন্ডার সংবেদনশীল না হওয়ায় স্থানীয় সরকারে তার প্রতিফলন ঘটেনি।
আরও বলা হয় পিআরএসপিতে বর্ণিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০০৭ সালের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসুিচতে(এডিপি) নারীদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমান ৩.২% থেকে ৬.২ এ উন্নীত করার কথা। অথচ ২০০৬-০৭ সালের বাজেটে তার প্রতিফলন নেই। কৃষিক্ষেত্রে নারীরা গুরুত্বপুর্ন অবদান রাখার পরও এখনও পর্যন্ত ১টিও নারী নির্ভর কৃষি উৎপাদনমুখী প্রকল্প হাতে নেয়া হয়নি। তেমনি শিল্পখাতে কেবল দু’একটি প্রকল্পে নারীদের প্রাধান্য রয়েছে তাও আবার ক্ষুদ্র ঋন ভিত্তিক। সরকার নারী শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিলেও বস্তুত শিক্ষা ক্ষেত্রে অ-উন্নয়ন ব্যয়ের সিংহভাগই পুরুষের দখলে। তাছাড়াও মেয়েদের জন্য মানসম্মত শিক্ষার যথেষ্ঠ অভাব রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের যাতায়ত ও আবাসন সমস্যা দুর করার জন্য উল্লেখযোগ্য কোন উদ্যোগ নেই। সরকারী ভাবে ৬ মাস গর্ভকালীন ছুটির বিধান থাকলেও বেসরকারী পর্যায়ে নারীরা এখনও সকল প্রতিষ্ঠানে এই সুযোগ পান না। শহরের গার্মেন্টস সেক্টরে এ অবস্থা আরও নাজুক। ফলে নারী অনেক নারীকেই চাকুরী নয়, সন্তান-ধারণ এর যে কোন একটিকে বেছে নিতে হয়। কর্মজীবি নারীদের সন্তানদের রক্ষনাবেক্ষণের জন্য এখনও পর্যাপ্ত দিবা যতœ কেন্দ্র স্থাপন হয়নি।
সংলাপে বাজেটকে গনতান্ত্রিক ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় বেশকতগুলি সুপারিশ করা হয়, তারমধ্যে স্থানীয় চাহিদা ও প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা তৈরী এবং বাজেটে নারীর মানবাধিকার ইস্যুগুলি, বিশেষ করে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, যৌণ হয়রানি নারী নির্যাতন হ্রাস, পারিবারিক নির্যাতন ও যৌতুক বন্ধ, জন্ম নিবন্ধন বৃদ্ধি, বিবাহ নিবন্ধন বৃদ্ধি ও স্থানীয় সরকারের কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহন জোরদারে অগ্রাধিকার ভাবে বিবেচনায় আনা। জাতীয় বাজেটে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের জন্য গনতান্ত্রিক ও সমভাবাপন্ন রূপ দিতে বাজেটের ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্র নারী-পুরুষ, উচ্চবিত্ত নারী-দরিদ্র নারী, মধ্যবিত্ত নারী-নি¤œবিত্ত নারী, মুসলিম নারী-হিন্দু নারী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের নারী, কর্মজীবি নারী-গৃহবধু ইত্যাদি প্রান্তিক জনগোষ্ঠি গুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোর সম্ভাব্য তুলনামুলক প্রভাব অনুসারে বরাদ্দ নির্ধারন করা। উপজেলা পরিষদকে পুর্নাঙ্গ করে পরিষদে নারী সদস্যদের অর্ন্তভুক্তি নিশ্চিত করা। ইউপি স্টান্ডিং কমিটি গুলি সচল করা, স্থানীয় বিভিন্ন কমিটিতে নারীর অংশগ্রহন নিশ্চিতকরা এবং কমিটির সভা নিয়মিত করা ও কমিটিগুলিকে সক্রিয় করা। স্থানীয় সরকারের বাজেটটি উন্মুক্ত করা, জেন্ডারকে ক্রস-কাটিং বিষয় হিসাবে অর্ন্তভুক্ত করতে হবে বাজেটের সকল খাতে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজন ভিত্তিতে ব্যয় বরাদ্দ প্রদান করে সবচেয়ে দুর্বল অংশ, কর্মজীবি নারী, শিক্ষার্থী, নির্যাতনের শিকার ইত্যাদি অংশের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো। নারীদের সরাসরি স্বার্থ-সংস্লিষ্ঠ খাত তথা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ক্ষুদ্র ঋন ইত্যাদিতে বিশেষ মনযোগ দিতে হবে এবং এ সমস্ত ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার সুরক্ষা করতে হবে। বিভিন্ন জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক নীতিমালা বিশেষ করে পিআরএসপি, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা, এমডিজির লক্ষ্য অর্জনে বাজেট স্থানীয় সরকারগুলির বাজেট ও পরিকল্পনা কতটা কার্যকর ও ইতিবাচক ভুমিকা রাখতে পারছে তা গুরুত্ব সহকারে যাচাই ও পর্যবেক্ষন করাসহ ২০ দফা সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদক ঃ কামরুন্নাহার শাম্পা সিনিয়র প্রকল্প কর্মকর্তা, সিএসডিএফ
Discussion about this post