এরশাদুল বারী কর্ণেল, রাবি:পদ্মা সেতু নির্মাণের নামে আদায়কৃত চাঁদার টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনায় গুলিবিদ্ধ আবদুল্যাহ আল হাসান সোহেল (২৪) নামে এক ছাত্রলীগ নেতা মারা গেছে। মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তার মৃত্যু হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণে আদায়কৃত চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে মাদার বখশ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের মাঝামাঝি জায়গায় কথাকাটাকাটির জের ধরে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের নেতাকর্মীদের মাঝে এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। নিহত ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল্যাহ আল হাসান সোহেল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের তৃতীয়বর্ষের ছাত্র (এতো বছর ড্রপ দেয়া) ও ছাত্রলীগের হল প্রস্তুত কমিটির শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক হল শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক, সামনের নতুন কমিটির সম্ভাব্য একমাত্র সভাপতি পদপ্রার্থী এবং সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের সমর্থক। তার বাসা রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার শহীদবাগ ইউনিয়নের সাবদী গ্রামে। চার ভাইবোনের মধ্যে সোহেল সবার বড়। তার পিতা আবদুস সালাম পেশায় একজন আমিন (ভূমি পরিমাপক) ও মা সানজেলা বেগম গৃহিণী। সে শেরবাংলা হলের ৩০৭ নম্বর কক্ষে থাকত।
দু’গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির পর রাত দেড়টা থেকে ভোর পর্যন্ত ওই দুটি হলে তল্লাশি চালিয়ে বেশ কিছু দেশি অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করলেও ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। পুরো ক্যাম্পাসে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। আবারও যে কোনো সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে শিক্ষার্থীরা।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে : দীর্ঘদিন পর গত ২৬ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ১৫৩ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পর থেকে সভাপতি আহম্মেদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক আবু হুসাইন বিপু গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে অধিপত্য বিস্তার নিয়ে মতবিরোধ শুরু হয়। সম্প্রতি পদ্মা সেতুতে সরকারের দুর্নীতির পর বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নিলে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয়ার পর গত সপ্তাহে ঘটাও করে রাবি ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের জন্য চাঁদা তোলা শুরু করে। সভাপতি গ্রুপের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের নেতাকর্মীরা পদ্মা সেতুর নামে আদায় করা টাকার অধিকাংশই হরিলুট করে সামান্য কিছু জমা দিচ্ছে। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের কর্মীরা সভাপতি গ্রুপের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করে।
ওই ঘটনার জের ধরে রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে মাদার বখশ হলের সামনে সাংগঠনিক সম্পাদক ও সভাপতি গ্রুপের নেতা তৌহিদ আল তুহিনের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের সমর্থক সহ-সভাপতি আখেরুজ্জামান তাকিমের কথা কাটাকাটি হয়। কথা কাটাকাটির সূত্র ধরেই একপর্যায়ে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। তুহিন আমার দেশকে বলেন, আমরা পদ্মা সেতুর ফান্ড কালেকশনে স্বচ্ছতার জন্য বক্স নিয়ে টাকা উঠালেও সেক্রেটারি গ্রুপের নেতা আরাফাত রাব্বি কোনো বক্স ছাড়াই বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় ১২শ’ টাকা তুলে মাত্র ৩শ’ টাকা জমা দেয়। বাকি টাকার কোনো হিসাব সে দেয়নি। পদ্মা সেতুর অর্থায়নে আদায়কৃত টাকার বিষয়ে রোববার রাতে তাকিমের সঙ্গে তুহিনের কথা কাটাকাটির সময় তাকিম সভাপতি আহম্মেদ আলী সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য এবং তাকে গালিগালাজ করে। এ সময় সে সভাপতির মাদার বখশ হলের ২৩৮ নম্বর কক্ষ লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। আমরা কিছু বলতে গেলে তাকিম পিস্তল দিয়ে আমাদের গুলি করতে থাকে বলে অভিযোগ করেন তুহিন।
এ সময় তুহিনের নেতৃত্বে সভাপতি গ্রুপের ২০/২৫ জন মাদার বখশ হলের সামনে এবং তাকিমের নেতৃত্বে সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের ২০/২৫ জন সোহরাওয়ার্দী হলের সামনে অবস্থান নিয়ে পিস্তল, হাসুয়া, রামদাসহ দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষের সময় উভয় গ্রুপের মধ্যে প্রায় ২৫/৩০ রাউন্ড গোলাগুলি হয়। এ সময় বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। সভাপতি গ্রুপের সমর্থকরা মাদার বখশ হলের ছাদে অবস্থান নিয়ে অপর পক্ষকে লক্ষ্য করে গুলি ও ইটপাটকেল ছোড়ে। সভাপতি গ্রুপ সমর্থকদের ছোড়া গুলি সোহরাওয়ার্দী হলের সামনে থাকা আবদুল্যাহ আল হাসান সোহেলের মাথা ভেদ করে। এতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সোহেল। এ সময় আহত হয় আরও কয়েকজন নেতাকর্মী। গোলাগুলির শব্দে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আহতের প্রথমে রাবি চিকিত্সা কেন্দ্রে নেয়া হয়। সেখান থেকে গুলিবিদ্ধ সোহেলকে রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে রাত ২টার দিকে সোহেলকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা মেডিকেলে গতকাল সাড়ে ১২টায় সোহেলের মৃত্যু হয়।
সোহেলের সঙ্গে থাকা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জহিরুল হক জাকির আমার দেশকে বলেন, মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আমি সোহেলের কাছে ছিলাম। তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। রামেক থেকে স্থানান্তর করার পর ঢামেকে সোমবার সকালে ডাক্তাররা তার মাথায় অপারেশন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই দুপুর সাড়ে ১২টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
আবাসিক হলে পুলিশের অভিযান : এদিকে গোলাগুলির পর রাত দেড়টার দিকে প্রথমে মাদার বখশ হল রেড দেয় মতিহার থানা পুলিশ। হল রেডের খবর শুনে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা গা ঢাকা দেয়। হল তল্লাশির সময় ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত কক্ষগুলো তালাবদ্ধ থাকলেও ২০১ থেকে ৪ ও ২৩৯ ও ২৪০ নম্বর কক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি চাকু, রড, হকিস্টিক উদ্ধার করে পুলিশ। পরে সোহরাওয়ার্দী হলে ভোর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে রামদা, হকিস্টিক ও লাঠিসোটা উদ্ধার করে পুলিশ। এছাড়া গতকাল দুপুরে অভিযান চালিয়ে বঙ্গবন্ধু হলের ৩২৭ ও ৩২৮ নম্বর কক্ষ থেকে কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া : এদিকে শাসকদলীয় ছাত্র সংগঠনের দু’গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির পর ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের এক জরুরি সভা ডাকা হয়েছে। রাবি ভিসি প্রফেসর এম আবদুস সোবহান বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। এ ব্যাপারে রাবি প্রফেসর এম আবদুস সোবহানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বার বার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি। প্রোভিসি প্রফেসর মুহম্মদ নুরুল্লাহ বলেন, আমরা সন্ধ্যায় সিন্ডিকেটে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। প্রক্টর প্রফেসর চৌধুরী মো. জাকারিয়া বলেন, ক্যাম্পাসের থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, নিয়ন্ত্রণে আনতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। এরই মধ্যে কয়েকটি হলে তল্লাশি চালানো হয়েছে। মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনিছুর রহমান জানান, ঘটনার পর রাতেই আমরা হলে তল্লাশি চালিয়েছি। ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি এখনও থমথমে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হুসাইন বিপু আমার দেশ-কে বলেন, ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগের ৮ নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সুপারিশ করা হচ্ছে বলে তিনি জানান। এরা হলেন, কমিটির সহ-সভাপতি আখেরুজ্জামান তাকিম, সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদ আল তুহিন, কৌশিক, তানিম, তাজমেরুল হক, আনজিম লিটন, সেতু ও রাজু।
সভাপতি আহম্মেদ আলীর সঙ্গে বার বার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম আমার দেশ-কে বলেন, ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত ছিল আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। আসলে কমিটি ভেঙে দেয়া বা বাতিল করাই কোনো সমাধান নয়। জড়িতদের ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে তিনি জানান। এদিকে এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন রাবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আরাফাত রেজা আশিক। তিনি এ ঘটনায় প্রক্টর প্রফেসর চৌধুরী মো. জাকারিয়ার দুর্বলতার কথা উল্লেখ পদত্যাগ দাবি করেন। এদিকে দুপুরের পর জানাজার জন্য নিহত সোহেলের লাশ ঢামেকের মর্গ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। জানাজা শেষে তার গ্রামের বাড়ি রংপুরের সাবদীতে নেয়া হবে।
গ্রামের বাড়িতে শোকের মাতম : কাউনিয়া (রংপুর) প্রতিনিধি জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থবর্ষের ছাত্র রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সাবদী গ্রামের আবদুল্লাহিল সোহেল নিহত হওয়ায় তার গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
জানা গেছে কাউনিয়া উপজেলার জামায়াতে ইসলামীর আমির সাবদী গ্রামের মৌলভী আবদুস সালাম এবং মোছা. আমজেলা বেগমের ইচ্ছে ছিল ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। সেজন্য ছেলেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সোহেল জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে, যোগ দেন ছাত্রলীগে। গত রোববার বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটি গঠন নিয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হুসাইন বিপুর সমর্থক সহ-সভাপতি আখেরুজ্জামান তাকিমের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আহমেদ আলীর সমর্থক সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদ আল তুহিনের বাকবিতণ্ডা থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপে মাদার বকশ ও সোহরাওয়ার্দী হলের সামনে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। রোববার রাতে ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলাকালে সোহেলের বাম চোখের উপরে মাথায় গুলি লাগে। গতকাল রাতে তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে জরুরি বিভাগে চিকিত্সাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে ১২টার দিকে সে মারা যায়। দু’ভাই এবং তিন বোনের মধ্যে আবদুল্লাহিল সোহেল ছিল সবার বড়।
এদিকে সোহেলের মৃত্যুর খবর কাউনিয়া উপজেলার সাবদী গ্রামে তার বাড়িতে পৌঁছলে চতুর্দিকে কান্নার রোল পড়ে। পুরো গ্রামে যেন নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
Discussion about this post