বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তার মধ্যে সর্বজনীন উৎসব হচ্ছে বাংলা নববর্ষ—পহেলা বৈশাখ। আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব কালক্রমে নতুন মাত্রা পেয়েছে। গ্রামীণ বা লোকজ সংস্কৃতি এখন নাগরিক সংস্কৃতি তথা সর্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসবের রূপ নিয়েছে। ফলে আদি উৎসবের নান্দনিকতা কিছুটা ক্ষুন্ন হয়েছে; আবার অন্য দিক থেকে দেখলে কিছুটা নতুন নান্দনিকতা যোগ হয়েছে। এ নিয়ে অবশ্যই বিতর্ক হতে পারে। তবে মোদ্দাকথা, পহেলা বৈশাখ আমাদের গ্রাম-শহরকে একসূত্রে বাঁধার কাজটা করেছে। অনেকেরই অভিযোগ, বৈশাখী উৎসবের নগরায়ণ করে শহুরের কেতায় সাজিয়ে এর আদি রূপকে, এর স্বাভাবিক স্বত:স্ফূর্ততাকে নষ্ট করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে বলা যায়, বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ এখন নতুন রূপ আর নতুন জেল্লা পেয়েছে। পহেলা বৈশাখ যেনবা নৌকা থেকে গরুর গাড়ি চড়ে শহরে এসেছে, শহর থেকে ট্রেনে চড়ে রাজধানীতে এসেছে। আর রাজধানী থেকে উড়োজাহাজে চেপে নানা দূর দেশে-দেশে-প্রবাসে ছড়িয়ে পড়েছে বৈশাখী উৎসব। তাই এখন টোকিও, টরন্টো, লন্ডন, নিউইয়র্ক, রোম, সিডনি বিশ্বের বিভিন্ন শহরগুলো মুখরিত হয়ে ওঠে বাঙালিদের বৈশাখী উৎসবে। প্রবাসে কর্মব্যস্ততা এবং জীবনসংগ্রামে সবাই হাঁপিয়ে ওঠেন। বিদেশি সংস্কৃতির মধ্যে বাঙালি যখন হাবুডুবু খায় তখন নিজস্ব শেকড় সন্ধানের মধ্যে কিছুটা আত্মতৃপ্তি খুঁজে ফেরে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে নিজের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য বড় মাধ্যম এই পহেলা বৈশাখ।ছেলে-মেয়েকে বলা হয়, এটা তোমার পিতৃপুরুষের আদি উৎসব। এই তোমার আত্মপরিচয়। বিদেশে মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে পিতৃপুরুষের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির প্রকাশও এক ধরণের অহংকার, গৌরব। কারণ, বিভূঁইয়ে তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম প্রজন্ম পর্যায়ক্রমে মিশ্র-সাংস্কৃতিক স্রোতে হারিয়ে ফেলে নিজ সংস্কৃতির অস্তিত্ব। সেজন্য শুধু স্বদেশ বা মাতৃভূমির স্বার্থেই নয়, বিশ্ব সংস্কৃতির স্বার্থেই প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের নিজ নিজ সংস্কৃতিকে চর্চার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা একান্ত আবশ্যক। এদিক দিয়ে, আমরা বাঙালিরা অন্যদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছি বলে আমার বিশ্বাস। প্রবাসীরা সারা বছরই ঘুরে-ফিরে বিজয়দিবস, শহীদদিবস তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতাদিবস, বৈশাখী উৎসব ইত্যাদি ছাড়াও রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তি, ঈদ-পুজো, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদা পালন এবং মহা উৎসবে উদযাপন করছেন। তুলে ধরছেন বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-অহংকারকে। এ প্রসঙ্গে একটি স্মরণীয় ঘটনা তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করছি।
২০০৫-এ টোকিওতে বৈশাখী উৎসব ১৪১২ আয়োজন করেন প্রবাসী বাঙালিরা। সেখানকার এক লেখক, সম্পাদক ও সংস্কৃতিকর্মী আমাকে নিমন্ত্রণ করলেন। আমি প্রস্তাব করলাম, আমার চেয়ে এমন একজনকে নাও যাতে মেলাটা আকর্ষণীয় হয়। প্রথমে হুমায়ূন আহমেদ পরে ইমদাদুল হক মিলনের নাম ঠিক করলাম। মিলন আর আমি ছাড়াও আরো দু’জন, সাংবাদিক মনির হায়দার ও নিশাত মুশফিকা, যোগ দিলাম নিশিকুচি পার্কের বৈশাখী মেলায়। অন্য এক অনুষ্ঠানে এসে যোগ দিলেন শাইখ সিরাজ, আদিত্য শাহীন প্রমুখ। খুব জমজমাট মেলা হলো দু’দিনব্যাপী। অনুষ্ঠানে টোকিও শিনতারো ইশিহানার বদলে যোগ দিলেন ডেপুটি মেয়র তোশিমা কু। তাঁর হাতে তুলে দেয়া হলো প্রতীকী শহীদমিনার। আর প্রবাসীরা দাবি জানালেন সেখানে একটি শহীদ মিনার স্থাপনের। মাননীয় মেয়র রাজি হলেন এবং দু’তিন মাস পরেই নিশিকুচি পার্কে প্রস্তাবিত শহীদ মিনার উদ্বোধন করলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। সৌভাগ্যক্রমে আর ঘটনাচক্রে টোকিও আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশ নেয়ার জন্য সেই সময় আবারও আমি টোকিওতে। দূতাবাস থেকে দাওয়াত পেলাম। হাতের কাছে পুষ্প নেই। তবুও আবেগে আপ্লুত হয়ে নিজের কোট থেকে ফিতাফুলের বেজ খুলে আমিই প্রথম পুষ্পাঞ্জলি দিলাম তাতে। আজ সূর্যোদয়ের দেশের রাজধানীর বুকে বাংলার শহীদমিনার দাঁড়িয়ে আছে! বৈশাখী মেলা থেকেই যার সূচনা করেছিলেন জাপানপ্রবাসী বাঙালিরা! কাজেই বৈশাখের সঙ্গে বিজয়দিবস, বিজয়দিবসের সঙ্গে রবীন্দ্র-নজরুল—পরস্পর সম্পৃক্ত। যে সম্পৃক্ততায় বাংলা সংস্কৃতি সমৃদ্ধ এবং সম্প্রসারিত। সেই সম্প্রসারণের জয় ও জোয়ারের দেখা পাই, তেরো হাজার মাইল দূরে সুদূর কানাডায়। কানাডায় সকল সম্প্রদায়ই নিজেদের নতুন বছর বরণ করে নিজস্ব সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে। তবে চীনাদের নববর্ষ উৎযাপন চোখে পড়ার মতো। এদিকে শিখ সম্প্রদায়ের আয়োজিত বাংলা নতুন বছর বরণের উৎসব উপলক্ষে বৈশাখী শোভাযাত্রায় যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার। কানাডার পশ্চিমে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের ভ্যাঙ্কুভার নগরীর গুরুদুয়ারা থেকে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। বৈশাখী শোভাযাত্রায় প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টি ক্লার্ক, ভ্যাঙ্কুভারের মেয়র জর্জ রবার্টসন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী উজ্জ্বল দোসাঞ্জসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ফলে বাংলাবর্ষবরণের উৎসব প্রবাসী বাঙালিদের ছাড়িয়ে অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী হারপার এক চিঠিতে প্রবাসী বাঙালিদের নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ সচরাচর ১৪ এপ্রিল তারিখেই পড়ে। আর এর কাছাকাছি শনি-রবি ছুটির দিন বিভিন্ন সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়। বাঙালিপাড়া পাড়ায় জমে ওঠে নানা আয়োজন। অথচ এক যুগ বা এক দশক আগেও এতো ব্যাপক হারে বৈশাখী উৎসব উদযাপিত হতো না। ঘরোয়াভাবে বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। পান্তা-ইলিশ ভোজনের পাশাপাশি ৫ বা ১০ ডলারের টিকিট কেটে প্রবাসীরা অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। যার সঙ্গে রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক বিষয়ও যুক্ত হয়েছে। আবার কিছুটা দল-কোন্দলও সৃষ্টি হয়েছে। বিগত ৩/৪ বছর ধরে দেখছি, প্রচণ্ড শীত ও তুষার পাত শেষ হয়ে বরফ গলে অপরূপ সবুজে ছেয়ে যায় পৃথিবীর অন্যতম সেরা শহর টরন্টো। আর টরন্টোবাসীও গা ঝাড়া দিয়ে জেগে ওঠেন শীতসমগ্র থেকে। ফলে বৈশাখী উৎসব প্রাণ পায় ভিন্ন মাত্রায়। প্রতি বছরই, বাংলাদেশ থেকে আসছেন খ্যাতিমান শিল্পীরা। রুনা লায়লা, আলমগীর, বেবী নাজনীন, শুভ্র দেব, অ্যান্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, কনক চাঁপা, তারিন, হায়দার হোসেন, শাহনাজ বেবী, মিলারা এসে উৎসবের অনুষ্ঠানগুলোকে জীবন্ত করে তোলেন। ক্ষণিকের জন্য হলেও গানে-গানে মনে হয় প্রবাসের হৃদয় ফুঁড়ে জেগেছে এক মিনি বাংলাদেশ। ঢাকার রমনার উৎসবের মতো না হলেও প্রবাসী বাঙালিরা সেজেগুজে, বিশেষ করে নারীদের শাড়িপরা মনে করিয়ে দেয় কুমার বিশ্বজিৎ-এর গানের কলি- ‘‘এক দিন বাঙালি ছিলাম রে…’’
তথ্যসূত্রঃ
১. দ্বিমাসিক পরিক্রমা, জুলাই-আগস্ট ২০০৫, সুইডেন এবং দৈনিক ভোরের কাগজ, জুলাই ১২, ২০০৫, ঢাকা
২. ডেইলি ভ্যাঙ্কুভার সান, এপ্রিল ১৭, ২০১১, ভ্যাঙ্কুভার, কানাডা।
লেখক: কানাডাপ্রবাসী সাংবাদিক
Discussion about this post