ডা. অপূর্ব পন্ডিত, ২৮ জুন’১৪: ফরমালিন এখন আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অনুষংগ উপাদান। শাক সবজি,ফলমূল, মাছ, মাংস সব কিছুতেই আজ ফরমালিন। হঠাৎ করে ঢাকাশহরের প্রবেশপথে চেকপোষ্ট বসিয়ে কিংবা দু’একটা মাছ বাজারে ভ্রাম্যমান আদালত পাঠিয়ে, আইনের ফাঁকাবুলি আওড়িয়ে ফরমালিনের হাত থেকে আমরা বাঁচতে পারবো ? নিশ্চয়ই না। বেনামে আমদানি হচ্ছে হাজার হাজার টন ফরমালিন। শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ফরমালিন আমদানি হয়েছে মাত্র ১১ টন, কিন্তু ফরম্যালডিহাইড বা প্যারা ফরম্যালডিহাইড নামে একই রাসায়নিক উপাদান আমদানি হয়েছে ১১ হাজার ৫শ’ টন। ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইনে ফরম্যালডিহাইড শব্দের উল্লেখ না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অবাধে এমন ক্ষতিকর পদার্থ আমদানির সুযোগ পাচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
পত্রিকার খবরে প্রকাশ, গাছ থেকে আম নামানোর পর পরই ফরমালিন মেশানো হয় তারপর কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়। সেই আম কিনে আনে কোন একজন ব্যবসায়ি। সে যদি জেনেও কেনে যে আমে ফরমালিন নেই, তা হলেই কি হবে? সেই আম যখন ঢাকায় আসার পথে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তাতে লাভ / ক্ষতি কার? এখন নাকি মাছে ফরমালিন মেশানো হয় না,ফরমালিন থাকে বরফের পানিতে। সরকার পলিথিন নিয়ে অনেক হৈ চৈ একসময় করেছে। এখন আবার সেই আগের মতোই অবস্থা। আম ট্রাকের তলায় পিষে আসলে ফরমালিন বন্ধ করা হচ্ছে কিনা তা আজ ভাবনার বিষয়। সাধারনের সচেতনতা পারে এই ঘাতকের হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে। তাই সাধারনের সচেতনতায় এই আয়োজন–
ফরমালিন কী?
ফরমালডিহাইড বা মিথানল গ্যাসের ৪০% জলীয় দ্রবণকে ফরমালিন বলা হয়।
ফরমালিন একটি কার্যকরী জীবাণুনাশক। প্রায় ৫০০০ সে. তাপমাত্রায় উত্তপ্ত সিলভার অথবা কপার প্রভাবকের উপর দিয়ে মিথানলের বাষ্প ও বায়ুর মিশ্রণকে চালনা করলে মিথানল আংশিক জারিত হয়ে মিথানল ও জলীয় বাষ্প উৎপন্ন হয়। ঐ মিথানল গ্যাসকে পানিতে চালনা করলে উৎপন্ন হয় ৩০-৪০% জলীয় দ্রবণ বা ফরমালিন ।
ফরমালিনের বৈশিষ্ট্য ও উৎপাদন ঃ
ফরমালিন একটি দাহ্য পদার্থ, তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত রাসায়নিক পদার্থ। এটি শিল্পে তৈরি একটি ক্যামিক্যাল। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই বছরে ৮.২ বিলিয়ন পাউন্ড এর অধিক ফরমালিন তৈরি হয় এবং বিশ্বব্যাপী এর বার্ষিক উৎপাদন ১৬ বিলিয়ন পাউন্ড এরও বেশি।
ফরমালিনের ব্যবহারঃ
এটি বাণিজ্যিক ছত্রাকনাশক, জীবাণুনাশক এবং ডিজ-ইনফেকট্যান্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মাছের প্রোটোজোয়া এবং ছত্রাকজণিত রোগের চিকিৎসায়ও ফরমালিন ব্যবহৃত হয়। চিংড়ি ও কার্প হ্যাচারীতে জীবানুনাশক হিসেবে ফরমালিন নির্ধারিত মাত্রায় ব্যবহার হয়।
USA Gi Food and Drug Administration ফরমালিনের ৩ ধরণের প্রোডাক্টকে পরজীবিনাশক এবং ছত্রাকনাশক হিসেবে US food fish aquaculture এ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
রসায়ন শিল্পে ফেনল-মিথানল বা ফেনল-ফরম্যালডিহাইড প্লাস্টিক বা ব্যাকেলাইট নামক প্লাস্টিক ও ইফরিয়া- ফরম্যালডিহাইড প্লাস্টিক বা ফরমিকা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
আয়না প্রস্তুতে বিজারক হিসেবে, রঞ্জক দ্রব্যের শিল্পোৎপাদনে মিথানল ব্যবহৃত হয়;
ল্যাবরেটরীতে প্রিজারভেটিভ হিসেবে ফরমালিন ব্যবহৃত হয়।
মানব দেহে ফরমালিনের ক্ষতিকর প্রভাবঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘১২৫ পিপিএম মাত্রার ফরমালিন মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে লিভার নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি শিশুদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে৷ প্যারালাইসিসসহ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ৷ সবচেয়ে বড় কথা একজন মানুষ এই ফরমালিনের প্রভাবে যে কোনো সময় স্ট্রোক হয়ে মারা যেতে পারেন৷’
ফরমালিন ইকোসিস্টেম এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকরযৌগের মধ্যে একটি। মৃত দেহ সংরক্ষণ ও এনাটমির বিষয়ে (০.৫-১.০ পিপিএম ফরম্যালডিহাইড নিয়ে সপ্তাহে ১ দিন ৩ ঘন্টা কাজ করে) ১০ সপ্তাহ কাজ করার পর তাদের মধ্যে যে সমস্ত উপসর্গ দেখা গিয়েছে তা হলো- নাকের প্রদাহ, শ্বাস কষ্ট এবং চর্ম প্রদাহ ইত্যাদি। দীর্ঘমেয়াদে ফরমালডিহাইডের সংস্পর্শে কাজ করলে রক্তের লিম্ফোাসাইট পরিবর্তন, নাসিকা টিস্যুতে মিউটেটিভ প্রভাব ইত্যাদি ঘটতে পারে। তবে স্বল্প সময় ব্যবহার এর কারণে এগুলো কাটিয়ে ওঠা যায় কিন্তু লম্বাসময় ধরে ব্যবহারে স্থায়ী সমস্যা দেখা দেয়, এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সমস্যা দেখা দেয় না।
ক্যান্সার সৃষ্টিকারি: শিল্প শ্রমিকদের উপর পরিচালিত কিছু গবেষণায় দেখা যায় যে, ফরম্যালডিহাইডের সংস্পর্শে যারা কাজ করেন তাদের নাকের ক্যান্সার, ন্যাসোফেরিঞ্জিয়াল ক্যান্সার এবং লিউকেমিয়া হওয়ার প্রবণতা বেশি। একাধিক গবেষণায় প্রতীয়মাণ হয় যে এনাটমিস্ট এবং অ্যাম্বালমার (যারা মৃতদেহ সংরক্ষণের কাজ করে) পেশার যারা ফরমালিন নিয়ে কাজ করেন তারা সাধারণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় লিউকেমিয়া এবং ব্রেন ক্যান্সারের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। ফরমালিন ফুসফুস ক্যান্সারের জন্যও দায়ী।
ফরমালিন চর্ম এলার্জি, শ্বসন সংবেদক এবং অ্যাজমা জাতীয় লক্ষণের জন্য দায়ী। বিভিন্ন গবেষণায় ফরম্যালডিহাইডকে জিন মিউটেশন (বংশ চরিত্র বাহকের পরিবর্তন) এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ফরমালডিহাইড চোখের রেটিনাকে আক্রান্ত করে রেটিনার কোষ ধ্বংস করে। ফলে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ধীরে ধীরে এসব রাসাযনিক পদার্থ লিভার, কিডনি, হার্ট, ব্রেন সব কিছুুকে ধ্বংস করে দেয়। লিভার ও কিডনি অকেজো, হার্ট দুর্বল এমনকি স্মৃতিশক্তি কমে যায়।
ফরমালিনযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করার ফলে পাকস্থলী, ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে ক্যান্সার হতে পারে। অস্থিমজ্জা আক্রান্ত হওয়ার ফলে রক্তশূন্যতাসহ অন্যান্য রক্তের রোগ, এমনকি ব্লাড ক্যান্সারও হতে পারে। এতে মৃত্যু অনিবার্য।
মানবদেহে ফরমালিন ফরমালডিহাইড ফরমিক এসিডে রূপান্তরিত হয়ে রক্তের এসিডিটি বাড়ায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে।
শিশুদের শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যায়। কিডনি, লিভার ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট, বিকলাঙ্গতা, এমনকি মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা দিন দিন কমছে।
গর্ভাবস্থা এবং ফরমালিন: গর্ভবতী মহিলাদের ফরমালিন নিয়ে কাজ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
মহিলাদের ক্ষেত্রে ভ্রুণের অস্বাভাবিকতা, গর্ভপাত, গর্ভস্রাব, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস এবং প্রসব জণিত অন্যান্য জটিলতা দেখা দেয়।
অধিকন্তু উল্লিখিত স্বাস্থ্য ঝুঁকিসমূহের পাশাপাশি ফরমালিন মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণের কারণে মানুষ ডাইজেস্টিভ সিস্টেম এর নানাবিধ জটিলতা বা গেস্ট্রো-ইন্টেস্টাইনাল ক্যান্সারসহ অন্যান্য জটিলতায় ভুগতে পারে।
দেখা যাচ্ছে, কয়েক দিন পরপর এসব রোগী ডায়রিয়ায় ভুগছেন, পেটের পীড়া ভালো হচ্ছে না।
কিভাবে মাছ থেকে ফরমালিন দূর করবেন ?
মাছ : এক ঘন্টার জন্য জলে মাছ ডুবিয়ে রাখলে ৬০ % ফরমালিন চলে যায়। বার বার পানি বদল করলে ফরমালিনের পরিমান আরও কমে। এক ঘন্টার জন্য নোনা পানির মধ্যে মাছ ডুবিয়ে রাখলে ৯০% ফরমালিন অপসারণ করা যাবে । ভিনেগার মিশিয়ে পানি (৯০% ভিনেগার, ১০% পানি)র ভেতর মাছ ডুবিয়ে রাখলে ১০০% ফরমালিন অপসারণ করা যায়।
ফল: সম্ভব হলে ভিনেগার পানিতে ভেজান। যদি ভিনেগার না থাকে তাহলে অন্তত ১ ঘন্টার জন্য ফলগুলো জলে ডুবিয়ে রাখুন । পারলে ২ / ৩ বার পানি বদল করুন এবং এতে ফরমালিন এর পরিমান আনেক কমে যাবে।
সবজি: রান্না করার আগে অন্তত ২০ মিনিটের জন্য নোনা পানির নিচে সবজি ডুবানো উচিত। এই পদ্ধতিতে সবজি থেকে ফরমালিন এর পরিমান কমে যাবে । কোন কোন সময়ে একেবারে থাকে না।
বাজারে ফরমালিন সনাক্তকরণের ফরমালডিহাইড মিটার বা পরীক্ষাযন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সঠিক মানের সঠিক যন্ত্রের ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। সবজি, মাছে ফরমালিন পাওয়া গেলেই মাছ,সবজি বিষাক্ত ভাবনাটাও ঠিক না। মাত্রাতিরিক্ত পাওয়া গেলেই তবে ব্যবস্থা নিতে হবে । এক্ষেত্রে ফলমূলে ফরমালিন বা ফরমালডিহাইডের উপস্থিতি মাত্রা গুরুত্বপূর্ণ। তবে আতঙ্কিত না হয়ে ফরমালিনের আগ্রাসন থেকে আমাদের বাঁচতে হবে, চাই উপযুক্ত আইন, আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং সাধারনের সচেতনতা।
লেখক: সম্পাদক, আমারহেলথ ডটকম, আবাসিক সার্জন, ন্যাশনাল হাসপাতাল, ঢাকা। মেইল- amadersastho@gmail.com
Discussion about this post