সৈয়দ মামুন হোসেন-এ দেশের অধিকাংশ লোকই বিদেশে পাড়ি জমায় কিছুটা উন্নত জীবন যাপনের আশায়। সেটা নিজের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য তেমনি সমানভাবে প্রযোজ্য তার পরিবারের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ পারিবারিকভাবে স্বাচ্ছন্দ জীবন- যাপনের প্রত্যাশায় অনেকেই দেশের মায়া ত্যাগ করে বিদেশে ছুটে যায়। তাদেরই একজন বাহরাইন প্রবাসী রেমিটেন্স সৈনিক সৈয়দ মামুন হোসেন। প্রবাস জীবনের ক্লান্তি দূর করতে ছুটিতে এসেছিলেন দেশে। সময় করে ঘুরে গেলেন প্রবাস মেলা কার্যালয়ে। কথা বলেছেন বাহরাইনে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ও শ্রমিক নিয়োগের অপার সম্ভাবনা নিয়ে।
সৈয়দ মামুন হোসেনের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় হলেও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা স্থায়ীভাবে ঢাকার গেন্ডারিয়ার সূত্রাপুরে বসবাস করছেন। ২০০৪ সালে মিরপুর বাংলা কলেজ থেকে ডিগ্রি শেষ করে শুরু করেন গার্মেন্টস ব্যবসা। কিন্তু দেশে এ ব্যবসায় ভালোভাবে থিতু হতে পারেননি বলে উন্নত জীবন-যাপনের প্রত্যাশায় ২০০৭ চলে যান বাহরাইনে। সেখানে তিনি একটি আন্তর্জাতিক হোটেল ম্যানেজমেন্ট ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন বলে জানান। বাহরাইন মূলত মধ্যপ্রাচ্যের একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। দেশটি পারস্য উপসাগরের পশ্চিম অংশের ৩৬টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। আমদানি নির্ভর বাহরাইনে বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে জানান সৈয়দ মামুন হোসেন। কাঁচাবাজারের পণ্য তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু সরবরাহ কম থাকায় দাম বেশি। তাই মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, ইয়েমেন, লেবানন, ইরান, মিশর, সিরিয়া ও দুবাইয়ের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, চীন, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন সমানে পাল্লা দিলেও সেই দৌড়ে বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সৈয়দ মামুন হোসেন। তিনি জানান, বাহরাইনের কাচা বাজার ঘুরে অল্প পরিমাণে হলেও বাংলাদেশ থেকে আসা করল্লা, সিম, আলু, পটল, কদু, কচুর লতি, কাকরোল, পানি কচু আর ঝিংগা দেখা যায়। কিন্তু এ বাজার গুলোতে বাংলাদেশের পণ্যের উপস্থিতি খুব কম। তিনি বলেন, বাহরাইনের মোট জনসংখ্যার ছয় ভাগের এক ভাগ হচ্ছে বাংলাদেশি। তাই চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দাম কিছুটা বেশি। দাম একটু কম হলে বাংলাদেশি সবজির সঙ্গে কোনো দেশ টিকতেই পারবেনা বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, বাহরাইনের রাজধানী মানামার বাঙালি গলির শত-শত দোকানে কদু, কাঁচামরিচ, মিষ্টি কুমড়া আর করল্লা আসছে সৌদি আরব ও ভারত থেকে। তাছাড়া চীন, ইয়েমেন আর লেবানন থেকে আসে আলু। ভারত আর চীন থেকে আসে রসুন। কলার বাজারে একচেটিয়া ফিলিপাইনের দখল। চালের বাজার দখলে রেখেছে পাকিস্তান, ভারত আর থাইল্যান্ড। শিমের বাজারে সৌদির সঙ্গে আছে ওমান। আদার বাজার ভারত আর চীনের। ডিম আসছে সৌদি, দুবাই, ভারত থেকে। বাহরাইনের স্থানীয় সরবরাহ আছে সামান্য। ভারত, মিশর, পাকিস্তান আর ইয়েমেন থেকে আসছে পিয়াজ। ওমান থেকে আসছে ধুন্দল। তবে বাহরাইনে পারস্য উপসাগরের জল তুলে মরুভূমিতে সীমিত পরিসরে করল্লা, বেগুন, ফুলকপি, বাধা কপি, টমেটো, চাষ হচ্ছে। সৈয়দ মামুন হোসেন জানান, প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে মৌসুমী ফল ও সবজির কদর অনেক বেশি। এখন বহু দেশে বেগুন, আলু, লাউ, কুমড়া, পটল, ঢ্যাঁড়স, পেঁপে, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, কাঁচামরিচ, বরবটি, শিম, টমেটোসহ বিভিন্ন সবজি রপ্তানি হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই এসব সবজির চাহিদা বেশি। প্রবাসীদের কাছে দেশি সবজির চাহিদা অনেক বেশি জানিয়ে সৈয়দ মামুন হোসেন বলেন, দেশি সবজির স্বাদই আলাদা। সুযোগ পেলেই বাংলাদেশি দোকানে যাই, খুঁজি দেশি ফল-মূল।
তিনি জানান, যথাযথ উদ্যোগ নিলে বাহরাইনের এ বাজারটা বাংলাদেশের দখলে আসতে পারে বলে মনে করেন অনেক বাহরাইন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। সেই সাথে দেশও রপ্তানির ক্ষেত্রে আরও সক্ষমতা অর্জন করবে। সৈয়দ মামুন হোসেন জানান, বাহরাইনে বর্তমানে কর্মরত দুই লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন। বাহরাইনে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীদের সিংহভাগ নির্মাণ খাতে কর্মরত। এ ছাড়াও কাঠমিস্ত্রি, মুদি দোকান, দর্জি দোকান, হেয়ার ড্রেসিং শপ, ট্রলারে করে মৎস্য শিকার, রেস্তোরাঁয় শেফ ও কুক, কৃষি ও বনায়ন খাতে বাংলাদেশিরা কর্মরত রয়েছেন। বাংলাদেশের একশ্রেণীর রিক্রুটিং এজেন্সি বাহরাইনে তাদের নিজস্ব দালাল নিয়োগ করে ভিসা কিনে থাকে। এ ছাড়া এখানে অবস্থানরত বাংলাদেশিরাই বিভিন্ন রকম প্রলোভন দেখিয়ে উচ্চমূল্যে ভিসা বিক্রি করছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ফ্রি ভিসা। প্রকৃত অর্থে এখানে ফ্রি ভিসা বলতে কিছু নেই। এসব অসাধু ব্যক্তিদের কারণে সহজ সরল ব্যক্তিরা সর্বশান্ত হচ্ছে, বাহরাইন এয়ারপোর্ট থেকে ভুক্তভোগীদের ফেরত আসা কিংবা বাহরাইনে আসার সাথে সাথে তার ভিসা বাতিল করে একই ভিসা আরেক বার বিক্রির অনেক ঘটনা তিনি দেখেছেন বলে জানান। বাহরাইনে বেতন ও কাজের পরিবেশ ভালো থাকায় প্রচুর লোক চাকরি নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশি কর্মীদের ভালো সুনাম থাকায় কাজের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। সরকারিভাবে নির্দিষ্ট কোটা না থাকলেও সে দেশে বাংলাদেশি কর্মীর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। সে কারণেই কর্মী যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। তাছাড়া বাহরাইনে বাংলাদেশি শ্রম উইং বেশ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে বলে তিনি জানান। কর্মীদের সুনাম এই ক্ষেত্রে বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বলেই তিনি মনে করেন।
একজন প্রবাসী হিসেবে সরকারের প্রতি কি দাবি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রবাসীদের যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয় না। বিদেশে কোন বাঙালি মারা গেলে স্বাভাবিক ভাবেই আপন বলতে তার কেউ থাকেনা। এমতবস্থায় মৃত ব্যক্তির লাশ দেশে আনতে ঝামেলা হয়। সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস সরকারের সাথে আলোচনা করে যতদ্রুত সম্ভব লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা করতে জোর দাবি জানান তিনি।প্রবাসীরা প্রবাস জীবন শেষে যখন একবারে দেশে চলে আসেন তখন তাদের পরবর্তী জীবন চলা কষ্ট হয় জানিয়ে এই প্রবাসী বলেন, প্রবাস পরবর্তী জীবন যাতে স্বাচ্ছন্দে চলতে পারে সে জন্য সরকার ব্যবস্থ করতে পারে। প্রবাস জীবন কঠিন ও কর্মময় জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা যতটা সম্ভব দূতাবাসের বিভিন্ন অনুষ্ঠান গুলোতে উপস্থিত থাকার চেষ্ট করি। মানামাতে বাংলাদেশ স্কুল বাহরাইন নামে একটি স্কুল আছে বলে তিনি জানান। যেখানে প্রায় ৭০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন।
(আলাপচারিতায় লেখা তৈরি ও সম্পাদনা করেছেন মো: বাছের আলী)
Discussion about this post