কক্সবাজার, ১৯ জানুয়ারি: টেকনাফের উপকূলীয় এলাকা দিয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রার সময় দেড় শতাধিক যাত্রী ভর্তি একটি কার্গো ট্রলার বঙ্গোপসাগরে ডুবে কমপক্ষে ১০ রোহিঙ্গা নাগরিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। শাহপরীরদ্বীপস্থ কোস্টগার্ড সদস্যরা ২৮ জন রোহিঙ্গা নাগরিকসহ ৩৫ জনকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় আরো শতাধিক ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন। সাগরে ডুবে এদের অধিকাংশই মারা গেছেন বলে ধারণা করছেন কূলে ফিরে আসা উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা।
সরেজমিনে জানা যায়, চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা থেকে মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক যাত্রী ভর্তি করে একটি কার্গো ট্রলার গত ১৮ জানুয়ারি রাতে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপস্থ বঙ্গোপসাগরে গিয়ে অবস্থান করে। স্থানীয় দালাল সদস্যরা দুইটি ফিশিং বোটে করে প্রায় ৪৫ জন রোহিঙ্গা ও স্থানীয় লোকজনকে ওই কার্গো ট্রলারে ওঠানোর পর ট্রলারটি রাতেই এলাকা ছেড়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা দেয়।
ভোর রাতে ট্রলারটি মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া নামক এলাকার অদূরে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে ট্রলার ফুটো হয়ে পানি উঠতে থাকে। এমতাবস্থায় ট্রলারে থাকা লোকজন কান্নাকাটি ও আর্তচিৎকার শুরু করে এবং ট্রলারডুবি থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। তবে কিছুক্ষণ পরই ট্রলারটি সাগরে ডুবে গেলে ট্রলারের লোকজন পানির কন্টেইনার ও ট্রলার ধরে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে।
লোকজন এরপরও অনেকে সাগরের ঢেউ আর স্রোতে ভেসে যায়। আবার অনেকেই দীর্ঘক্ষণ পানিতে সাঁতার কেটে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। সবাই সাগরে ভাসতে থাকে। এদের মধ্যে কিছু হতভাগ্য ব্যক্তির মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু হয়।
এমন অবস্থায় মিয়ানমার থেকে কাঠভর্তি একটি বাণিজ্য ট্রলার টেকনাফ স্থল বন্দর উদ্দেশে আসার পথেই গভীর সমুদ্রে এ দৃশ্য দেখে হতভাগ্য লোকজনদের মধ্যে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে উদ্ধার করে ট্রলারে তুলে নেয়। ট্রলারটি শাহপরীরদ্বীপ বদর মোকাম এলাকায় পৌঁছে স্থানীয় জালের নৌকা ও চর এলাকায় এসব লোকজনদের নামিয়ে দেয়।
খবর পেয়ে শাহপরীরদ্বীপ এলাকার কোস্টগার্ড স্টেশনের কন্টিজেন্ট কমান্ডার মো. ওবায়দুল হক পৃথক পৃথক কয়েকটি টিম নিয়ে বঙ্গোপসাগরে অভিযানে নামে।
কোস্টগার্ড সদস্যরা বিভিন্ন নৌকাতে আশ্রয় নেয়া ও ভাসমান ৩৫ জনকে উদ্ধার করেন। উদ্ধারকৃতরা হলেন- মৌলভী আজম (৩০), মো. শাহ (১৮), শফিক (২০), জোবায়ের (১৬), আবদুল্লাহ (১৮), আবদুর রহিম (২২), কেফায়েত উল্লাহ (২৫), নজির আহমদ (৪০), শাহ আলম (১৮), ফয়েজ (২২), সিরাজুল হক (২০), করিম উল্লাহ (১৭), শবিবর আহমদ (৩০), আবদুল হামিদ (২২), হাফিজ উল্লাহ (২৫), আমান উল্লাহ (২০), রহমত উল্লাহ (২২), মো. রফিক (২৭), আতা উল্লাহ (১৮), হারুন (১৭), কবির আহমদ (১৩), শামশুল আলম (২৪), ইয়াছিন (২০), মো. আবদুল্লাহ (১৭), ছৈয়দ হোছন (১৯), শামশুল আলম (২০)। এসব লোকজন সবাই মিয়ানমারের মংডু, হাস্যলতা, বদুছরা, কুদুছরা এলাকার বাসিন্দা বলে জানা গেছে। এছাড়া টেকনাফের হ্নীলা নয়াপাড়া এলাকার মো. ইউনুছ (২২), পালংখালী ফারিরবিল এলাকার হামিদ হোছন (৩০), শাহপরীরদ্বীপ মিস্ত্রি পাড়া এলাকার দিল মোহাম্মদ (৪২), আবু বক্কর (৩০), মোচনী শরণার্থী ক্যাম্পের আবুল কালাম (৪৭), টেকনাফ সদর ইউনিয়নে র গোদার বিলের আবদুল গফুর (২২), মোস্তাফাকেও (২০) কোস্টগার্ড সদস্যরা বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ধার করে আটক করেছে। টেকনাফ থানা পুলিশে এসব লোকজনকে সোপর্দ করা হয়।
জানা যায়, স্থানীয় শাহপরীরদ্বীপের দালাল সিন্ডিকেটের সদস্য মো. হাসেম, শরীফ হোছন ভুলু, মাইক ইউনুছ, ফিরুজ, দালাল বশর, মিয়ানমারের ৭ নং সেক্টরের দংখালী এলাকার মুছলেকুর রহমান, গর্জং দিয়ার আবদুর রহিম, হাফেজ মহি উদ্দিনসহ বিভিন্ন দালাল সদস্যরা মিয়ানমার ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজনদেরকে উক্ত কার্গো ট্রলারে করে মালয়েশিয়া পাঠাচ্ছিল।
কোস্টগার্ডের হাতে আটক টেকনাফের নয়াপাড়া এলাকার আবুল কালাম কাঁদতে কাঁদতে ট্রলারডুবির ঘটনা বর্ণনা দিয়ে জানান, শাহপরীরদ্বীপের পশ্চিম পাড়া থেকে রাতে দু’দফা যাত্রী ওঠানোর পর মালয়েশিয়া যাত্রাকারী ট্রলারটি সাগরে গিয়ে ফুটো হয়ে ডুবে গেলে নিজেরা সবাই মনে করেছিল সাগরে তাদের সলিল সমাধি হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে জীবনবাজি রেখে নিজেই অপরাপর ১৬/১৮ জন হতভাগ্য ব্যক্তির করুণ মৃত্যু দেখেছে। সাগরে প্রাণ রক্ষার জন্য একে অপরকে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে গিয়েও চাপ সইতে না পেরে অনেকেই মারা গেছে।
উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা আরো জানিয়েছেন, অনেকেই পানির স্রোতে ভেসে গেছে। আবার অনেকের করুণ মৃত্যু হয়। মৃত ব্যক্তিদের লাশ সাগরে ভাসছে।
টেকনাফে কর্মরত কোস্টগার্ড কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট বদরোদ্দোজা জানান, সাগরে মালয়েশিয়াগামী ট্রলারডুবির ঘটনায় নিখোঁজ লোকজনদের উদ্ধারে কোস্টেগার্ডের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
Discussion about this post