মঈন উদ্দিন সরকার সুমনঃ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মেয়েদের মত কোন অংশে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের নারীরা। শুধু শহরের মেয়েরা নয় অজোঁপারা গাঁয়ের মেয়েরাও এখন এগিয়েছে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। জীবন সংগ্রামে পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেনে। একই সাথে স্বামীর কাঁদে কাদ মিলিয়ে সমান অধিকারে নিজেকে সংসারের জন্য বিলিয়ে দিচ্ছেন। সংসারের পাশাপাশি সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রেখেছে সাফল্যের ছাপ। এ সাফল্য শুধু একটা জায়গায় সীমাবদ্ধ নয়। দেশে এবং বিদেশে উভয় জায়গাতেই সমান ভাবে সমাদৃত। এমনই এক সফল নারী রেমিটেন্স যোদ্ধা কুয়েত প্রবাসী আমিনা আক্তার। তার জীবনের সুখ দুঃখ নিয়ে প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন।
আমেনা আক্তার রেনু ১৯৭৩ সালে চাঁদপুর জেলার মতলব থানার নব কলশ গ্রামের মোল্লা বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম এম এ আওয়াল মাতা মরহুমা সুর্জাহান এর ছোট মেয়ে। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। সবে মাত্র হাইস্কুলে ভর্তিহন সে সময় ঢাকা বড় ভাই সিরাজুল ইসলামরে বাসায় চলে আসেন। ভাইয়ের বাসায় থাকা অবস্থায় পরিবারে পছন্দের পাত্র মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার দামলা গ্রামের মিয়া বাড়ীর মরহুম আজহার মিয়ার ষষ্ঠ সন্তান একে এম আরিফ এর সাথে বিয়ে হয়।
১৯৯০ সালে ১৭ জুলাই স্বামীর সাথে কুয়েত প্রবাসীর খাতায় নাম লেখান, শুরু হয় জীবন যুদ্ধ। অনেকের মত শুধুমাত্র গৃহীনির সারিতে থাকেননি স্বামীকে সহযোগিতা করার কথা চিন্তা করে স্বামীর কাঁদে কাদ মিলিয়ে কর্মে যোগদেন। একটি ক্লিনিং কোম্পানিতে দীর্ঘ এক বছর কাজ করার পর অন্যদের মত ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে কুয়েতে স্বনামধন্য আমেরিকানা ফুডষ্টাফ কোম্পানি কেএফসি তে কুক সহকারী হিসেবে যোগদেন। মিসরি, ইন্ডিয়ান ও ফিলিপিনোদে সাথে পাল্লাদিয়ে কাজ করেন। সেই সময়কার কথা স্বরণ করে বলতে গিয়ে অশ্রুশিক্ত কন্ঠে জানান কর্মজিবনের অনেক কষ্টের কথা। এরই মধ্যে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কিছুটা আরবি শিখেছিলেন আর ইংলিশ কিছুটা বুঝতে পারলেও উত্তর দেয়ার ক্ষমতা ছিলোনা তখন। ভাষাগত সমস্যার কারনে দীর্ঘদিন বকনি শোনেছেন দায়িত্বরত সুপারভাইজার ও ম্যানেজারদের কাছ থেকে। তিন জনের কাজ একাই করতেন, সহ কর্মিরা দেখানো আদর করে বলত এটা কর ওটা কর।
যখন সুপারভাইজার বা ম্যানেজার আসার সময় হয় তখন তাকে আদর করিয়ে খেতে দিত। কর্মকর্তারা এসে দেখত আমিনা খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত আর তখনি শোনতে হত বকনি, নিরবে কেঁদেছেন বুঝতে পারেননি কি তার দুষ। একদিন সহমর্মিতা জাগলো সহকর্মিদের একজনের, আমেনাকে ডেকে বললেন তুমি কি কোম্পানির কাজের নিয়ম কানুন জাননা। বোর্ডে একটি চার্ট দেখিয়ে ঐ দেখ এখানে কার কি কাজ সব স্পষ্ট করে লেখা আছে। তুমি প্রতিদিন এই রুটিন অনুসারে কাজ করবে তুমার সহকর্মি অন্যকারো কথা শোনে নয়। সে থেকে শুরু নতুন আরেক জীবন। কঠোর পরিশ্রমী হওয়ায় স্বল্প সময়ে কোম্পানির মালিক থেকে শুরু করে সুপারভাইজার ম্যানেজার সবার কাছে পছন্দের কর্মি হয়ে উঠেন। দুই বছর কাজ করার পর কোম্পানিতে স্থায়ী নিয়োগের সময় হলে আকামা পরিবর্তেনে সমস্যার কারণে ঐ কোম্পানি নতুন করে ভিসা দেয়, সেই ভিসা নিয়ে কেএফসিতে যোগ দেন। এই কোম্পানিতে এক মাত্র বাংলাদেশী নারী আমিনা যাকে কোম্পানি ভিসা দিয়ে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ সময়ে কর্ম জীবনে সত নিষ্ঠা আর কঠোর শ্রমের কারনে কোম্পানি কর্তৃক পেয়েছেন সম্মাননা। কোম্পানির সবার কাছে মামা আমিনা (মা আমিনা)নামে উপাধি পান। বাঙ্গালী হিসেবে প্রথমে ঐ কোম্পানিতে অবহেলায় জীবন কাটলেও বর্তমানে বেশ কৃতিত্বের সাথে কাজ করছেন তিনি। শুরুথেকে থেকে দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা কাজ করেছেন। এমন আস্থা যোগিয়েছেন কর্মকর্তাদের কাছে বর্তমানে দেরিতে আসা বা আগে যাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা করে না। এই অক্লান্ত পরিশ্রমি আমিনা বর্তমানে সকালে আরেক স্থানে পার্টটাইম কাজ করেন। ।একজন সাধারণ কর্মচারি হিসেবে কর্ম করে যাচ্ছেন। বর্তমানেও দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘ্ন্টা কাজ করেন, তার পর আছে স্বামী সংসার। নিজেকে নারী ভেবে কখনো পিছু হটে যাননি, কর্মস্থলে সততা আর পরিশ্রমের গুণে নিজের প্রচেষ্টায় সফল নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যদিও নারীর প্রতি ভিন্ন মনোভাব বর্তমানে সমাজে অনেকটা দূর হয়েছে। বর্তমানে তাদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। বড় ছেলে মোহাম্মদ আহাদ তুর্জয়(২০) মেয়ে আফরিন রাশা (৯) কুয়েতে আল আমান ইন্ডিয়ান স্কুলের শিক্ষার্থী। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন ঘরে বসে সময় নষ্ট করার চেয়ে কাজ করা ভালো মনে করেন। পাশাপাশি ছুটির দিনে অবসর সময়ে কুয়েত প্রবাসিদের আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। পহেলা বৈশাখে সহ বিভিন্ন মেলায় নিজ তৈরি পিঠা পায়েস নিয়ে হাজির হন পরিবেশন করেন মনের সুখে। প্রবাস জিবনে যোগিয়েছেন কয়েকজন বান্ধবী মিনু, মমতাজ, সালমা, ইতি ও ডালিয়া কোন অনুষ্ঠানে এক সাথে দল বেঁধে চলেন। দেশে পরিবার পরিজনকে ফেলে সুদুর প্রবাসে তারাই অবসর সময়ের সঙ্গী। পরিবার সমাগম করা হবে এমন অনেক অনুষ্ঠানে বান্ধবী মহল দলনেত্রী হিসেবে আমন্ত্রন সবার আগেই থাকে। সামাজিকতায় সবার আগে থাকে সেই স্বীকৃতি স্বরুপ অনেক সংগঠন থেকে পেয়েছেন পুরস্কার ও সম্মাননা।
স্বামী আরিফ একটি কোম্পানিতে দায়িত্বরত ভালো একটি চাকুরি করছেন। তিনিও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জরিত। তিনি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করেন, কারণ জীবন যুদ্ধে প্রত্যেকটা কাজে তাঁর স্ত্রীকে সাথে পেয়েছেন। স্ত্রীকে নিয়ে গর্ব করেন আরিফ।
বর্তমান যুগে পুরুষ শাসিত সমাজ বলে যারা অপবাদ দেয় এবং নারীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে যখন সবাই চিন্তিত তখন আমিনার মত অনেক নারী দৃষ্টান্ত হয়ে দাড়ায় এই সমাজে। জাতীয় কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর” কথা গুলি সত্য প্রমানিত হয়।
Discussion about this post