‘আমি খুবই ছোট। অত্যন্ত ক্ষুদ্র। নিজেকে ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেবার মতো অবস্থান এখনও আমার হয়নি। জীবনে তেমন কিছুই করতে পারিনি। যে স্বপ্ন দেখেছিলাম,তার কাছেই যেতেই পারিনি। তবে হ্যাঁ, এটা সত্যি আমার পরিবার অত্যন্ত গরীব ছিলো। বাবার কাছে কলেজের ফি চাইলে বলতো আজ না কাল। আর সেই ভাগ্য অন্বেষণেই আমার এদেশে আসা’ – কথাগুলো বলছিলেন কুমিল্লার চৌদ্দ গ্রামের চান্দিসকরা গ্রামের ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারী (৪৮)। কুয়েত সরকারের কাছে এই ‘ছোট মানুষটির’ পরিচয়ই তিনি বড় ব্যবসায়ী। ডায়মন্ড ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ অব কোম্পানিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ব্যবসার বিস্তৃত করেছেন যে গ্রুপের অধীনে, সে গ্রুপের অধীনে কুয়েত, ভারত, বাহরাইন, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করেন ২৭’শয়ের বেশি কর্মকর্তা, কর্মচারী। চলাফেরার খুবই সাধারণ। বিনয় আর সৌজন্যতায় অনন্য। রাজতন্ত্রের দেশ কুয়েতে ব্যবসা বাণিজ্য যা কিছু করতে হয় তার সব কিছুর মালিকানায় থাকে কুয়েতিরা। বিশেষ করে তাদের নামে লাইসেন্স নিয়ে অনেকটা তাদের ‘প্রযত্নেই’ বা যৌথভাবে ব্যবসা করতে হয়। কিন্তু ব্যতিক্রম কেবল জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারী। নিজের নামেই তার স্থানীয় পরিচয় (লোকাল আইডি), ব্যবসা বাণিজ্য। সবকিছু। উপসাগরীয় যুদ্ধের পর ১৯৯২ সালের ২৩ জুলাই তিনি পা রেখেছিলেন এই প্রবাসে।
প্রবাসে আসার গল্পটাও এখনো গর্বে বলে বেড়ান তিনি। আমি খুবই গরীবের ছেলে। চৌদ্দগ্রাম কলেজ থেকে এসএসসি শেষ করে ভর্তি হলাম কর্মাসে। বাবার কাছে ফি চাইতাম। বাবা আতাউর রহমান পাটোয়ারি। বলতেন,আজ না কাল। জানতাম, বাবার পক্ষে কলেজের সামান্য ফি’টাও দিতে কষ্ট হচ্ছে। তখন মনে হতো একটা কিছু করার দরকার। কিন্তু ওই যোগ্যতায় কি করবো দেশে। আমার না আছে বাপ, দাদার সম্পদ, না আছে টাকা। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম অদক্ষ শ্রমিক হিসেবেই সৌদি আরব যাবো। সবকিছু চূড়ান্ত। আমার বন্ধু আহমেদ শাকুরের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত চলে আসি কুয়েতে। এখানে কুয়েত ন্যাশনাল রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে (কেআরএস) কাজ শুরু করি। সুপারভাইজার পদে বেতন ছিলো মাত্র ৭৫ কুয়েতি দিনার(কেডি)।
১৯৯৭ সালে ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিই মারজুক রাশেদি জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানিতে। কোম্পানির কাজ ছিলো বড় বড় নির্মাণ প্রকল্পে ঠিকাদারি করা।
ততদিনে কুয়েতের ব্যবসা বাণিজ্য আর সম্ভাবনার দিগন্তগুলো ধরা দিয়েছে আমার হাতে। ২০০১ সালে ডায়মন্ড ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ অব কোম্পানিজে যোগ দিই পার্টনার (অংশীদার) হিসেবে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
এ ছাড়াও আমাদের দেশে চট্টগ্রামে সরকারি মালিকানাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারির চাইতেও আরো আধুনিক ও উন্নত ব্যবস্থাপনায় দুবাই ও বাহরাইনে গড়ে তুলেছি কেবি (কুয়েত-বাংলাদেশ) পেট্রোকেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ও কেবি (কুয়েত-বাংলাদেশ) ল্যুবরিক্যান্ট প্লান্ট নামের দুটি রিফাইনারি। এর মধ্যে দুবাইতে ২২ মিলিয়ন ডলার ও বাহরাইনে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৪২ মিলিয়ন ইউএস ডলার।
পাশাপাশি ভারতের বোম্বে ও গুজরাটে রয়েছে উন্নত মানের দুটি রাইস মিলস।
আমাদের কনস্ট্রাকশন ফার্ম এখানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে বহু কাজ করেছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনের সামরিক সদর দপ্তরের সেন্ট্রাল কমান্ডে নিবন্ধিত। এ ছাড়াও আমার গ্রুপটির অধীনে রয়েছে নয়টি কোম্পানি। যার মধ্যে রয়েছে টিস্যু কারখানা, ডেন্টাল হসপিটাল, ফুড স্টক কোম্পানি, পেট্রোকেমিক্যাল ও ল্যুবরিক্যান্ট বিপণন কোম্পানি। বিশ্বের ৫০টির অধিক দেশে আমাদের পেট্রোকেমিক্যালস পণ্য রপ্তানি হয়।
ব্যক্তি জীবনে স্ত্রী মনোয়ার জাহান শিউলী ও চার সন্তানকে নিয়ে জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারীর সংসার।
দেখুন আমি আগেই বলেছি, যা হতে চেয়েছিলাম তা হতে পারিনি এখনো। সব সময় আমি মনে করি আজ আমি কোথায় আর কোথা থেকেই বা এসেছি।
তবে মা বাবার প্রেরণা ছিলো সব সময় একজন ভালো মানুষ (গ্রেট ম্যান) হবার। কতটুকু হতে পেরেছি জানি। তবে আমার সন্তানদের এখন সেই প্রেরণা দেই সব সময়।
অনেকে আমার অতীতের জীবন নিয়ে হয়তো তাচ্ছিল্য করতে পারেন। তবে আমি অহংকার করি না। বলি আমি চেষ্টা করছি, কিছু একটা হতে। কয়টা ধনীর দুলাল আছে যে বাবার ব্যবসা থেকে আরো বিশাল পর্যায়ে নিয়ে গেছেন? সংখ্যাটি কিন্তু খুবই কম।
আমার বাপ দাদার তেমন কিছু ছিলো না। নিজে কিছু একটা করার চেষ্টা করছি মাত্র। শূন্য হাতে মরুভূমির দেশে এসেছিলাম। চেষ্টা করছি দেশের মানুষের জন্যে কিছু করার। দেশে-ও প্রচুর বিনিয়োগ করা হয়েছে। সেখানেও কর্মসংস্থান হচ্ছে বহু মানুষের। জীবনের কষ্টকর অতীত থেকে এ জায়গায় উঠে আসার মূলমন্ত্র কি?
নিঃসন্দেহে সততা আর পরিশ্রম। কাউকে ছোট করে দেখবেন না। সবাইকে সম্মান দিন। নিজের আত্মবিশ্বাসকে প্রসারিত করুন। সফলতা আসবেই। যোগ করেন কুয়েতের বিশাল ব্যবসায়ী আর নিজের কাছে ‘ছোট মানুষ’ পরিচয় দেয়া জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারী।
Discussion about this post