স্মৃতি কথা:গুড়ের জিলাপি :
গাজী আবু হানিফ
আমার বাড়ি হতে সাত কিলোমিটার দূর কসবার বাজার।কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে হতো।বর্ষাকালে লোকেরা রেললাইনও কাচাসড়কপথে দল বেঁধে হেঁটে হেঁটে আসাযাওয়া করতো।আর সুদিন মাস মানে হেমন্ত ও শীতকালে যেতো কোনাকোনি মাঠের মধ্যে দিয়ে।তখন জমিগুলো রোদে ফেটে চৌচির হয়ে থাকতো।গ্রীষ্মকালেতো একেবারে ঠনঠনে হয়ে যেতো।এঁটেল মাটির জমি গুলো বড় বড় ফাটা দিয়ে বৃষ্টির জন্যে হাহাকার করতো। আর বৃষ্টি হলেই একেবারে নরম হয়ে যেতো। এসব ফাটা চাক্কার উপর খালি পায়ে হাঁটা যেতো না।মাঝেমধ্যে আইল দিয়ে হাঁটতাম। আর হেঁটে হেঁটে লোকের পায়ের চলায় জমির উপর দিয়ে পথ হয়ে যেতো।আবার শীতকালে গম ও সরিষা ক্ষেতের মাঝখান দিয়েও লোকেরা পথ করে ফেলতো।কেউ আবার বরই কাঁটা দিয়ে রাখতো।
তবে হাটবার দিন পথে পথে লোকের সারি দেখা যেতো।বায়েক,নয়নপর,কৈখলা,রগুরামপুর,কাশিরামপুর,রাউতখলা,চাটুয়াখলা,কায়েমপুর,মন্দবাগ,শ্রীপুর,মইনপুরের লোকজন দলে দলে সে হাটে যেতো।এছাড়া মাঝেমধ্যে কুটি, চান্দলা বাজারেও যেতো।এ ছাড়া মন্দভাগ হাটও সে সময়ে বেশ জমজমাট ছিল।
হাটে যাওয়ার বেশ অভ্যাস ছিল আমার।হাটবারে কসবা,মন্দবাগ,চান্দলা বাজারে যেতাম।বাজারে গেলেই গুড়ের মচমচে গরম গরম জিলাপি খেতাম।
কারিগররা নেকড়ার মধ্যে জিলাপির কাই লয়ে হাত নাচিয়ে কি সুন্দর করে গোল গোল করে দ্রুত পেঁচিয়ে জিলাপি তৈরি করতো। আমি অনেক সময় কারিগরের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।আর অবাক হতাম তেলের মধ্যে কিভাবে এত দ্রুত আলাদা করে করে কড়াইয়া ভরে বানাতো।
সে ছেলেবেলার কথা।মানুষের আশ্চর্য কাজ দেখলে মনে হতো আমিও শিখি।কৌতুহলী মন কতকিছু ভাবতো।
বাবা প্রায় সময়ই লুকিয়ে চলে যেতেন।একবার কয়েকজন লোক বলাবলি করলো তারা কুটি বাজারে যাবে।আমি সে সময়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি।কুটি বাজারের অনেক নামদাম ও বড়বাজার বলে গল্প শুনেছি।
তাই, তাদের দিনটি মনে রাখলাম।তখন রবিবার দিন স্কুল বন্ধ থাকতো।আমি সকাল থেকেই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।মাকে বলে রাখলাম,আমি কুটি বাজারে কোনোদিন যাইনি,মা।মা যথারীতি ভয় দেখালো।অনেক ছেলেমেয়ে সে বাজারে হারিয়ে যায়। তবে বাজারে যে ছেলেমেয়েরা হারায় এটা সত্য। একবার কসবার মুসলেমগঞ্জ বাজারে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এ বাজারে তরকারি বাজারের সাথে গরু-ছাগলের জমজমাট হাট বসতো।গরু কেনাবেঁচার হাছিল লেখার জন্যে লোকেরা মাইক রাখতো।বাবা,এত লোকের ভীড়ে আমাকে ধরে রাখতে পারেনি।আমিও লোকের ধাক্কায় বাবার হাতটি ছেড়ে দেই।হাতে সেদিন ব্যথাও পেয়েছিলাম।প্রায় ঘন্টা খানেক বাজারে একা একা ঘুরতে থাকি।এদিকে বাবাও হয়রান।মাইক থেকে আওয়াজ এল,একটি এমুক গ্রামের এমুক নামের ছেলে হারানো গিয়েছে। তাকে মাইকের সামনে আসার জন্য তার বাবা ডাকছে।তাই সে ডাক শোনে ভীড় ডিঙিয়ে মাইকের কাছে যেতেই বাবা বুকে জড়ায়ে ধরলেন।
তবু বাঁধা মানেনি মন।কুটি বাজারে যেতেই হবে।দেখতে হবে সে বাজার কি রকম? কায়েমপুর থেকে কোনাকোনি উত্তর পশ্চিম দিকে কুটি বাজার।মাঠ দিয়ে গেলে দশ এগারো কিলোমিটার হবে।হেঁটে এতদূর যাওয়া তখন মানুষের জন্য এত কষ্টকর মনে হতো না।এটা ছিলো তাদের দৈনন্দিন অভ্যাস।তারা ভীত হতো না।পায়ে ও মনে বেশ জোর ছিলো। আর হাঁটা ব্যতীত কোনো উপায়ও ছিলো না।আমি বাবার হাত ধরে চলতে লাগলাম।প্রথমে গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ।তারপর মাঠ।মাঠে শীতের ফসল।গম আর সরিষা,কাউন।
মা গোছল করিয়ে শরীরে খাঁটি সরিষার তেল মেখে চুল আঁচড়ায়ে দিল।বাবাকে বলে রাখলো হাতে ধরে রাখতে। আমি বল্লাম: হারাবো না মা।হারালে মাইকের কাছে চলে যাবো।
কুটি লম্বা চওড়া বাজার।কত দোকানপাট।ঘরগুলো তখন টিনের ছিলো। মাঝেমধ্যে দুএকটা ঘর আস্তরহীন পোড়া ইটের ছিলো। মিষ্টি দোকানগুলো বেশির ভাগ হিন্দুদের ছিলো। সেদিনও সে বাজারটি ঘোরে দপখা হলো।আসার সময় রাত হয়ে গেল।পথে শেয়ালের ডাকে ভয় পেয়েছিলাম।
হাজার বছর ধরে বাংলার মানুষের ঐতিহ্যবাহী প্রিয় খাবার গুড়ের জিলাপি।এখনও জিলাপি অনেকের প্রিয়। ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিরা ব্যতীত ছোটবড় সকলেই এসব জিলাপি পছন্দ করে। বাপদাদার মুখে মুখে এমন ঝোলা ও পাটালি গুড়ের জিলাপির কথা প্রচলিত ছিল। আর তারা এগুলো পছন্দ করতো।চিকন মোটা সাইজের জিলাপি তৈরি করে কারিগররা।এখনতো গুড়ের জিলাপির প্রচলন কমে গেছে। তখন শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় রসগোল্লার পাশাপাশি গুড়ের জিলাপি নিত জামাইগণ।এতে শ্বশুর বাড়িতে বেশ কদর জুটতো।
আমার বাড়ি হতে পাঁচ ছয় কিলোমিটার দূরে চান্দলা বাজার।অনেক বিরাট বাজার।এ ছাড়া কসবায়ও আছে বড় বাজার।বিজনা নদী পার হইতো নৌকা দিয়ে। তখন ছিল নাও ঘাট।নাওঘাটকে কেউ কেউ গুদারা বলতো।আর সেখানে গিয়ে পকেটে থাকতো না ভাঙতি পয়সা।এ নিয়ে বেশ লজ্জাও পেতে হতো।শুনেছি মহেশ কোম্পানির মালিক এখানে গুদারা পার হতে এসে ভীষণ লজ্জায় পড়ে।তাকে কেউ চিনতেও পারিনি। গুদারা ভাড়া না দিতে পারায় তার ছাতা রেখে দেয়।আর সেই লোক রাগ করে এখানে স্টিল ব্রিজ করে দেয়।
বাবার সাথে ঠিকই চান্দলা বাজারে গেলাম।এ বাজার রাস্তার দুই পাশে ও বড় ফাঁকা জায়গায় বসে।বড় বড় মিষ্টি দোকান।নানা প্রকার জিলাপি বানিয়ে তারা সাজিয়ে রাখে।জিলাপি দেখলেই আমার জিহবা খাওয়ার জন্যে নেচে উঠে। আবার বাড়ির জন্যও নিয়ে আসতাম।মা-ও জিলাপি ভালো বাসতো।
এখনো সে বাজারে গুড়ের জিলাপি পাওয়া যায়। কিন্তু কালের খেয়ায় জিলাপি এখন চিনি দিয়ে তৈরি হয় বেশি।তবে গুড়ের জিলাপির তুল্য কি হয়? এখনো চান্দলা বাজারে গেলে গুড়ের জিলাপি নিয়ে আসি।







Discussion about this post