
প্রতিবেদক: মঈন উদ্দিন সরকার সুমন| কুয়েতের কৃষি অঞ্চল ওফরা কিংবা আবদালির বিভিন্ন ফার্মে বাণিজ্যিকভাবে সবজিচাষ বেশ পরিচিত বিষয়। এসব অঞ্চলে অনেক কুয়েতি নাগরিক শখের বশে চাষাবাদ করেন। তাঁদের কেউ কেউ সবজির পাশাপাশি দু-একটি করে ফল গাছের চারা রোপণ করে থাকেন আম, পেঁপে, কলা, বড়ই, আনারস, তীন, তোত ইত্যাদি। আমি একজন প্রবাসী পাশাপাশি সংবাদকর্মীও, এই পেশাগত জীবনে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের নানা মিডিয়ায় কুয়েতে মরুভুমির উত্তপ্ত গরমে বিভিন্ন চাষাবাদ নিয়ে আগেও অনেক প্রতিবেদন প্রচার করেছি। কিন্তু সম্প্রতি কুয়েতে বানিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কলা বাগান দেখে সত্যিই বিস্মিত। কুয়েতি একজন কৃষি উদ্ভাবক যিনি মরুর দেশে ওয়াফরা অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে কলা চাষে সফলতা অর্জন করেছেন। আমার কৌতুহল ছিলো কুয়েতের উত্তপ্ত আবহাওয়া ও মরুপ্রবণ ভূমিতে কলা চাষ স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয় বলেই মনে হয়েছে। আমি সরাসরি যোগাযোগ করি কৃষি উদ্ভাবক , ঈদ শারি আল আজমি এর সঙ্গে। দীর্ঘ কথা হয় তাঁর এই সাফল্য নিয়ে। তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানান তাঁর ফার্মে। একদিন সকালে কুয়েত সিটি থেকে শত মাইল দূরে মরুভুমির বুক চিরে পথ পারি দিয়ে পৌঁছালাম ওয়াফরা। ফার্মে পৌঁছানোর পর আমাকে স্বাগত জানান তিনি নিজেই, বসানো হলো তাঁর দেওয়ানিয়ায়। যেখানে আরব আতিথেয়তায় ঐতিহ্য কফি (গাওয়া) ও চা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় আমাকে। শুরু হয় দীর্ঘ আলাপচারিতা। এরপর তিনি নিজেই নিয়ে যান তাঁর সবুজে মোড়ানো বাগানে। তাঁর ফার্মে আমি দেখতে পাই বিস্ময়কর সব চাষাবাদ আম, আপেল, পেঁপে, নীল চা, কমলা, লেবুসহ আরো অসংখ্য ফলের গাছ, যা কুয়েতের মতো দেশে কল্পনাও করা যায় না। তবে আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কলা চাষ। আমি সরাসরি তাঁকে প্রশ্ন করি, আপনি তো চাইলেই অন্য যেকোনো ফলের বাণিজ্যিক চাষ করতে পারতেন, তবুও কেন বিশেষভাবে কলা চাষের দিকে ঝুঁকলেন? ঈদ শারি আল-আজমি উত্তর দিলেন অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে। আমার কলা বাগান শুরু করার পেছনে কয়েকটি নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমত, কলা গাছে খুব দ্রুত ফলন ধরে, অন্য অনেক ফলের তুলনায় সময় কম লাগে। দ্বিতীয়ত, একটি কলা গাছ থেকে অনেক নতুন চারা গজায়, এতে উৎপাদন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়তে থাকে। তৃতীয়ত, ইকুয়েডর থেকে আনা এই জাতের কলা গাছ তুলনামূলকভাবে খাটো, ফলে পরিচর্যা সহজ এবং জায়গা সাশ্রয়ী হয়। তিনি আরও বলেন: আমি প্রমাণ করতে চেয়েছি কুয়েতের মতো মরুভূমিতেও আধুনিক প্রযুক্তি, সেচব্যবস্থা ও মাটির ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এমন একটি ফল চাষ করা সম্ভব, যেটি সাধারণভাবে এখানে জন্মায় না। এটা শুধু চাষ নয়, বরং এক স্বপ্নকে বাস্তব করার প্রয়াস ছিলো। ঈদ শারি আল আজমি তাঁর এই কলা চাষের যাত্রা শুরুটা ছিলেঅ মাত্র ৮টি কলা গাছের চারা দিয়ে, যা তিনি ইকুয়েডর থেকে সংগ্রহ করেছিলেন কয়েক বছর আগে। সেই চারা এখন পরিণত হয়েছে ২৪ হাজারের বেশি কলা গাছে। তিনি জানান এক মাস পর তাঁর বাগানে কলা গাছের সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০ হাজারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তখন প্রতিবারে এই বাগান থেকে তিন থেকে পাঁচশত বক্স কলা উৎপাদন করবেন, যা তিনি সরবরাহ করবেন কুয়েতের বাজারে। প্রতিটি গাছের ফলন বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, কুয়েতে এটি একটি বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক ও টেকসই কৃষি মডেল। আমি জানতে চাইলাম, তাঁর ফার্মে কোন দেশের শ্রমিকরা কাজ করছেন, বিশেষ করে বাংলাদেশিদের ভূমিকা কী? ঈদ শারি আল আজমি স্পষ্ট ভাষায় জানালেন: তাঁর ফার্মে বর্তমানে ৫০ জন শ্রমিক কাজ করছেন, যাঁদের মধ্যে ৩৫ জনই বাংলাদেশি। তিনি মিসর, সোমালিয়া, সুদান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা ও ভারত থেকেও শ্রমিক এনেছেন, কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমিকরাই সবচেয়ে ভালো কাজ করছে বলে জানান।

তিনি বলেন বাংলাদেশীরা পরিশ্রমী, বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণভাবে কলা গাছের স্বভাব, পরিচর্যা ও উৎপাদন পদ্ধতি ভালো করেই জানে। তিনি বাংলাদেশিদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মিলের কথাও উল্লেখ করে বলেন বাংলাদেশীরা মুসলিম, তাই আমাদের পরিবেশ ও রীতি নীতি কিছুটা বুঝে । অনেক প্রশংসা করেন বাংলাদেশী শ্রমীকদের। তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেন তার ফার্মে আরো বাংলাদেশী নিয়োগ দেবেন। যা তিনি সরাসরি বাংলাদেশ থেকে প্রকৃত কৃষকদের আনবেন। মরুভূমির বুকে কলা চাষে এমন সাফল্য নিঃসন্দেহে এক কৃষি বিপ্লব। ঈদ শারি আল-আজমি নিজেকে শুধু একজন উদ্ভাবক হিসেবেই নয়, বরং কুয়েতে কলা চাষের পথিকৃৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর এই ফার্ম যেমন আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির সফল প্রয়োগের উদাহরণ, তেমনি এটিতে কাজ করা বাংলাদেশি শ্রমিকদের দক্ষতা, অধ্যবসায় এবং পরিশ্রম আজ বিশ্বব্যাপী সম্মান অর্জন করছে। কুয়েতে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে কলা উৎপাদনকারী হিসেবে ঈদ শারি আল-আজমির এই উদ্যোগ কেবল একজন কৃষিপ্রেমীর স্বপ্নপূরণ নয়, বরং এটি কুয়েতের কৃষি খাতে এক যুগান্তকারী অর্জন। আর এই অর্জনের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ঘাম, নিষ্ঠা ও শ্রমের অমূল্য অবদান।
লেখক: সাংবাদিক মঈন উদ্দিন সরকার সুমন
সভাপতি বাংলাদেশ প্রেসক্লাব কুয়েত
Discussion about this post